Main Menu

সরাইল পিডিবি’র হাজারো সমস্যা ভৌতিক বিল আতঙ্কে ১৬ হাজার গ্রাহক

+100%-

মোহাম্মদ মাসুদ, সরাইল থেকেঃ ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সরাইলে হাজারো সমস্যায় চলছে পিডিবি’র বিদ্যুৎ সরবরাহ।  মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ বৈদ্যুতিক খুঁটি। শত বছরের পূরাতন তার। ডিজিটাল মিটার লাগানোর চাপ। জনবল সংকট। পিডিবি’র অবৈধ লাইন। দালালদের দৌরাত্ব। ভোল্টেজ সমস্যা। মিটারের সাথে অসঙ্গতিপূর্ন মোটা অঙ্কের ভৌতিক বিল। অবকাঠামোগত চরম অব্যাবস্থাপনা। অন্তহীন সমস্যায় চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়ে গ্রাহকদের দিন কাটছে। প্রচন্ড দাপদাহে ঘন ঘন লোডশেডিং’র থাবায় দিশেহারা সাধারন গ্রাহকরা। সামান্য ঝড় বৃষ্টিতে লাপাত্তা হয়ে পড়ে বিদ্যুৎ। ১২/১৪ ঘন্টা সরাইল থাকে অন্ধকারে। টাকা না পেলে গ্রাহক সেবা বুঝেন না কর্মচারীরা। কাগজে পত্রে নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে উন্নীত হলেও জনবলের কোন পরিবর্তন হয়নি আদৌ। বাড়েনি সেবার মান। মাস শেষে শত শত গ্রাহক ভীড় জমায় প্রকৌশলীর দফতরে। সকলের অভিযোগ একটাই মিটারের সাথে বিলের কোন মিল নেই। এত কিছুর পরও তাদের মাসিক সিস্টেম লছ শতকরা ৩০ ভাগ।
সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহকের জন্য মিটার রিডার রয়েছে মাত্র একজন। রিডিং না দেখেই তৈরী করা হচ্ছে অনুমান নির্ভর মোটা অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল। মাস শেষে বিুদ্ধ গ্রাহকরা অতিরিক্ত বিলের কাগজ নিয়ে দৌড়ে আসেন নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে। সেখানে চলে গ্রাহকদের হা হুতাশ আর দেন-দরবার। এনালগ মিটারের পরিবর্তে ডিজিটাল মিটার লাগিয়েও হয়রানী থেকে মুক্তি পাচ্ছে না গ্রাহকরা। ভৌতিক বিল হাতে অনেক দিনমজুর, অসহায় দরিদ্র গ্রাহকের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠে বিদ্যুত অফিসের পরিবেশ। সুযোগে বিল কমিয়ে দেওয়ার কথা বলে আরেক দফা শোষন করা হয় গ্রাহকদের। আগামী মাসে বিল কম আসবে। মিটারে সমস্যা আছে। স্যার আসুক দেখি কি করা যায়। আতাউর ভাইয়ের সাথে দেখা কইরেন। ইত্যাদি বাণী শুনিয়ে গ্রাহকদের বিদায় করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।  উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাফিজটুলা গ্রামের হাসেন মিয়া। অফিসের চাপে অতিরিক্ত রিডিং থেকে মু্িক্ত পাওয়ার আশায় কর্জ করে ডিজিটাল মিটার লাগিয়েছেন পাঁচ মাস পূর্বে। তার হিসাব নং-১৫০৭৯। মিটারের রিডিং ৪৫৯ ইউনিট। আর বিলের কাগজে বর্তমান রিডিং ৯৬০ ইউনিট। পাঁচ মাসে ওই গ্রাহক থেকে অগ্রিম অতিরিক্ত ৫‘শ ইউনিটের ৪ সহস্রাধিক টাকা আদায় করে নিয়েছে পিডিবি। শান্তনা শুধু এখন থেকে বিল ছোট করে দিব। এ রকম সমস্যায় ভুগছেন সরাইলের ১৬ হাজার গ্রাহক। এনালগ মিটারের গ্রাহকরা ও বিদ্যুতের কাছে পাবে শত সহস্র ইউনিট। অতিরিক্ত বিল বন্ধ করার দাবীতে এখানকার গ্রাহকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সভা করেছে। এ বিষয়ে একাধিক বার উপজেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিদ্যুত কর্তৃপক্ষের আশ্বাস দুই বছরে ও আলোর মুখ দেখেনি। গ্রাহকরা এখন হতাশ। স্থানীয় বিদ্যুত অফিস সূত্রে জানা যায়, সমগ্র উপজেলায় রয়েছে শতাধিক বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার। ৪০ বছরের মধ্যে একটি ট্রান্সফরমারের ও সংস্কার করা হয়নি। এক সময় ট্রান্সফরমারের মধ্যে “লাইটিং ষ্টার” নামক একটি যন্ত্র লাগানো হতো। ১১ কেভি ও ৩৩ কেভি লাইনের উপর থাকত শক্তিশালী আর্থিং। ফলে বজ্রপাতে ট্রান্সফরমার ও লাইনের কোন ক্ষতি করতে পারত না। এখন আর এ প্রযুক্তি গুলো নেই। তাই সামান্য বজ্রপাতেই দেখা দেয় বিদ্যুত বিভ্রাট। ঘন ঘন বিকল হয়ে পড়ছে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার।
যে ভাবে হচ্ছে দূর্নীতিঃ
নতুন সংযোগ, মিটার বদল, চোরাই লাইন সহ হাজারো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় বিদ্যুতের কিছু লোক। দৈনিক ভিত্তিতে কর্মরত কিছু লোক গ্রাহকদের সাথে করেন চরম দূর ব্যাবহার। মিটার পরিবর্তনের সময় কর্র্তপক্ষের নিয়মে রয়েছে চরম স্বার্থপরতা। গ্রাহকের পাওনা দেওয়ার কোন বিধান নেই। কিন্তু বিদ্যুতের এক টাকাও বকেয়া রাখা যাবে না। মিটার বদলের সময় কিছু কর্মচারীকে মাসোহারা দিতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে ইষ্টিমিট বিলের চাপ। ৭/৮ হাজার টাকার কমে নতুন সংযোগ পাওয়া যায় না। একটি সংযোগ থেকে ৫/৬ পরিবারকে লাইন দিয়ে রেখেছে মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মচারী। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। প্রভাবশালী কিছু মোটা তাজা কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও গ্রাম্য মাতব্বরকে বিশেষ শর্তে দেয়া হয়েছে হিটারের লাইন। অফিসকে ফাঁকি দিয়ে কিছু কর্মচারী চোরাই লাইন দিয়ে রেখেছেন। মিটারের বাহির থেকে ও গোপন সংযোগ রয়েছে অনেক জায়গায়। মাস শেষে নগদ টাকা নেন নিজের পকেটে।  জরাজীর্ণ বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার দিয়ে চলছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। অনেক জায়গায় পল্লী বিদ্যুৎ ও পিডিবি’র লাইন একসাথে টানা। ট্রান্সফরমার ও রয়েছে পাশাপাশি। কোনটি কার বুঝাও মুশকিল। ২/৩ কিলোমিটার দূরত্বের লাইন টেনে রেখেছেন এক তারে। খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন বাঁশ ও জীবিত গাছকে। উপজেলার নোয়াগাঁও ও কাটানিশার গ্রামে এ জাতীয় লাইন রয়েছে। টাকার বিনিময়ে বাণিজ্যিক কে দেখানো হচ্ছে আবাসিক। আবার মাসোহারা না পাওয়ায় আবাসিক লাইনের বিল বাণিজ্যিক হিসেবে করে দেখানো হচ্ছে কারিশমা। রাইস মিল, গভীর নলকূপ ও শেলু মেশিন মালিকরা কৌশলে বিদ্যুতের লোকজনকে হাত করে ফাঁকি দিচ্ছেন বিল। টাকা কামাই করছেন বিদ্যুতের কিছু লোক। আর এর বুঝা টানছেন সাধারন গ্রাহকরা। অনেক সময় এক জনের বিল চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে আরেক জনকে। লোড না নিলেও টাকা বাড়িয়ে দিলেই সংযোগ পান রেফ্রিজারেটর (এসি) ও সেচ পাম্পের মালিকরা। তারপর রয়েছে ট্রান্সফরমার ও খুঁটি বসানোর বাণিজ্য। কমপক্ষে ২০/৩০ হাজার টাকা দিলে দ্রুত আসে ট্রান্সফরমার। টাকা না দিলে বিকল ট্রান্সফরমার খুঁটিতেই ঝুলে থাকে সপ্তাহ মাস বছর।  সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেই এসব খুঁটি ভেঙ্গে ও তার ছিঁেড় ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। কোথাও কোথাও চরম ঝুঁকির মধ্যে টিনশেডের বসতঘরের উপর দিয়ে এক তার দিয়ে চলছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। পিডিবির মিটার আছে কিন্তু সরকারের খাতায় বিল জমা হচ্ছে না। লাইন আছে তাও এক তারে টান্ া,পুরোটাই অবৈধ। বাতি জ্বলে তবে তিন হাত দূরে কি আছে দেখা যায় না।                    
মাষ্টারোল কর্মচারীদের দাপটঃ
জনবল সংকটের কারনে সরাইল পিডিবিতে মাষ্টার রোলে কাজ করছে কিছু লোক। তাদের দাপটের কাছে অনেক সময় কর্মকর্তারা হয়ে পড়েন অসহায়। তারা ও গ্রাহকদের বিশেষ চুক্তিতে কাজ করেন। মাসোহারার টাকা কম হলেই চরম উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অনেক সময় গ্রাহকদের অপমান করতে ও দ্বিধা করেন না। তারা বড় বড় কাজের কন্ট্রাক্ট নেন। গ্রাম এলাকায় নিজেদেরকে বিদ্যুতের বড় কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। গর্বের সাথে বলে থাকেন, নির্বাহী প্রকৌশলী বা আর ই কি ? আমি ই সব কিছু। লোকজন ভয়ে আতঙ্ক গ্রস্থ হয়ে পড়ে। আর তারা সুযোগে আখের গোচায়। সরাইলের অধিকাংশ এক তারের লাইন তাদেরই উপহার। একাধিক বার ধরা ও পড়েছে। গণমাধ্যমে বিষয় গুলো প্রকাশ ও হয়েছে। কিন্তু কথায় আছে- ইজ্জত যায় না ধুঁইলে আর হাছিয়ত যায় না, না মরলে। তারা এখনো আগের অবস্থায়ই আছে।
পিডিবি’র বকেয়া ৭ কোটি টাকাঃ
সরাইল পিডিবি’র অফিস সুত্র জানায়, ফেব্রুয়ারী/ ২০১৩ পর্যন্ত মোট বকেয়া ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। উপজেলার মসজিদ মন্দির ও মাদ্রাসার এক কোটি টাকা বিদ্যুত বিল বকেয়া রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্টানের নিকট বকেয়া আছে ৩০ লাখ টাকা। এলাকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্টানের কাছে বকেয়া আছে ৩০ লাখ টাকা। এ সব বকেয়া বিলের চাপ সাধারন গ্রাহকদের উপর পড়ছে। কর্র্তৃপক্ষকে অধিক আমদানী দেখানোর জন্য সাধারন গ্রাহকদের কাছ থেকে মনগড়া বিল আদায় করা হচ্ছে এমন অভিযোগ অধিকাংশ গ্রাহকের।
গরীবের নামে মামলা প্রভাবশালীরা নিরাপদঃ
সাধারন গ্রাহক যাদের বকেয়া বিল ৩০ হাজার টাকা বা তার উর্ধ্বে। তারা বিদ্যুতের মামলায় ঝুলছেন। অনেক গ্রাহকের বিলে “মামলা প্রক্রিয়াধীন” সীল থাকে। যা দেখে আতকে উঠে গ্রাহক। ধরনা দিতে থাকে বিদ্যুতের কিছু লোকের কাছে। ভিজিটের বিনিময়ে মামলা থেকে রক্ষার ভূয়া আশ্বাস দেয় তারা। উপজেলায় এমন মামলার সংখ্যা দুই শতাধিক। ওদিকে প্রভাবশালী ব্যক্তি,বিভিন্ন প্রতিষ্টান ও সরকারি দফতরে ৭ কোটি টাকা বকেয়া থাকলেও অজানা কারনে তারা আছেন নিরাপদে। তাদের বিলের কাগজে মামলার সীলটি পর্যন্ত মারা হয় না।
যন্ত্রপাতি ও জনবল সঙ্কটঃ
গত ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সরাইল উপজেলা আবাসিক প্রকৌশলীর দফতর থেকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দফতরে (বিক্রয় ও বিতরন বিভাগ) উন্নীত হয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে দাপ্তরিক কাজ। সৃষ্টি হয়েছে পদ। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় নেই পরিবহন। ক্যাটাগরি অনুযায়ী এখানে রয়েছে ৩২ জনের পদ। আছে মাত্র ১৭ জন। জনবল সঙ্কটের কারনে বিঘিœত হচ্ছে দাপ্তরিক ও টেকনিকেল কাজ।
প্রসঙ্গতঃ আশুগঞ্জের কলাবাগান নামক স্থানে ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রটি।  ৩০ কি: মি: দূরে সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে স্থাপিত ৩৩/১১ কেভি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি। এখান থেকেই গোটা সরাইলে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। এতে  ৪-৫% সিষ্টেম লস হয়। শাহবাজপুর  উপকেন্দ্রটি একেবারে খোলা হাওড় এলাকায়। কেন্দ্রটির ১(এক) বর্গ কি: মি: এর মধ্যে কোন বাড়িঘর নেই। ওই উপকেন্দ্রে কোন অভিযোগ কেন্দ্রও নেই। নেই কোন  এস, বি,এ  নেই। একজন ুইলেক্ট্রিশিয়ানকে সার্বনিক ওই উপকেন্দ্র পরিচালনা করেন। তাকে সহায়তার জন্য দৈনিক ভিত্তিতে দুইজন লোক রাখা হয়েছে। যাদের বেতন প্রতি মাসের অগ্রদত্ত হতে দেয়া হয়। ঝড়-বৃষ্টির সময় মাথা গোজারও কোন স্থান নেই।  এমন পরিস্থিতিতে লাইন বন্ধ  ,চালু করা, লোডশেডিং ইত্যাদি কাজের জন্য ২৪ ঘন্টা  লোকের প্রয়োজন। সেখানে কোন লোকজন রাখা সম্ভব হয় না। ফলে বিদ্যুত বিভ্রাট লেগেই থাকে। লোকবল বৃদ্ধিসহ  ১১ কেভি  এল টি লাইন জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন। সদ্য যোগদানকারী সরাইল উপজেলা পিডিবি’র নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম নূর উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ম দূর্নীতির সত্যতা পেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির  বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাবে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। গড় বিল বন্ধ করে দিয়েছি। ভৌতিক বিল বন্ধের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করছি। সকলের সহযোগিতা পেলে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হবে।
ছবি- ই-মেইলে আছে।






Shares