কথাশিল্পী অদ্বৈত মলবর্মণের জন্মশতবার্ষিকী ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক কর্মসূচী
প্রতিনিধি॥ ১লা জানুয়ারি বাংলা ভাষার অমর কথাশিল্পী, তিতাস একটি নদীর নাম কালজয়ী উপন্যাসের রচয়িতা অদ্বৈত মলবর্মণের জন্মশতবার্ষিকী। সরকারি উদ্যোগে অদ্বৈত মলবর্মণের জন্ম-মৃত্যুদিন পালনের দাবী জানানোর মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে তিতাস সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ। কর্মসূচীর মধ্যে থাকবে শহীদ ধীরেন্দ্র দত্ত ভাষা চত্বর থেকে আনন্দ শোভাযাত্র, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে আলোচনা, নিবেদিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও অদ্বৈত মলবর্মণের জন্মস্থান গোকর্ণ ঘাটে অদ্বৈত ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক। সকালে অদ্বৈত জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের আহবায়ক এটিএম ফয়েজুল কবীরের সভাপতিত্বে কর্মসূচী উদ্ধোধন করবেন বিশিষ্ট লেখক, ভাষা সৈনিক এড.আবদুস সামাদ। প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন পৌর মেয়র মো. হেলাল উদ্দিন। আলোচনায় অংশ নেবেন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক মানবর্দ্ধন পাল।
এক দরিদ্র ধীবর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তাঁর পিতার নাম ছিল অধরচন্দ্র। শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন হন তিনি। গ্রামের মালোদের চাঁদার টাকায় তাঁর লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ হতো।
১৯৩৩ সালে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা সদরে অবস্থিত অন্নদা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর কুমিল্লা জেলার ভিক্টোরিয়া কলেজে কিছুদিন আই,এ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সঙ্কটের কারণে তাঁর পড়ালেখা শেষ হয়ে যায়।
১৯৩৪ সালে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে কলকাতা গমন করেন। সেখানে মাসিক ‘ত্রিপুরা’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। এরপর ১৯৩৬ সালে ক্যাপ্টেন নরেন দত্ত পরিচালিত ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় যোগ দেন তিনি।পত্রিকাটির সম্পাদক কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকারী হিসেবে সহ-সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। নবশক্তি’র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র “মাসিক মোহাম্মদী” পত্রিকার সম্পাদকের সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। তিন বছর একাধিক্রমে এ পদে দায়িত্ব পালন করেন অদ্বৈত। এ সময়ে একই সঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছিলেন তিনি।
এছাড়াও, নবযুগ, কৃষক ও যুগান্তর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। আয় বৃদ্ধির জন্য বিশ্বভারতীর প্রকাশনা শাখায় খণ্ডকালীন চাকুরীও গ্রহণ করেন তিনি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের সমগ্র সাহিত্যিক জীবনে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি অমর কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতিকূল সংঘাতে ক্রমশ মুছে-আসা মৎস্যজীবী যে মানুষদের কাহিনী এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে তিনি সেই ‘মালো’ সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন।তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সুগভীর অন্তঃদৃষ্টির কারণেই উপন্যাসটিতে ধীবর সমাজের নিষ্ঠুর জীবনসংগ্রামের সাধারণ কাহিনীকে দিয়েছেন অবিনশ্বর ও অসাধারণ।
উপন্যাসটির ভূমিকাংশে তিনি লিখেছেন,“ তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরর হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তাঁরারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। ”
তিতাস নদী ও তার দু’কূলের মানুষের জীবনযাত্রাকে ঘিরে রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে কিশোর, সুবল, অনন্ত, বনমালী প্রমুখ চরিত্রগুলো স্থান পেয়েছে। উপন্যাসটির সামগ্রীক মূল্যায়ন ও বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনীকার অধ্যাপক শান্তনু কায়সার। তাঁর মতে,‘তিতাস জীবনের শেকড় প্রাকৃত জীবনের গভীরে প্রোথিত। এই প্রাকৃত জীবনকে বাইরে থেকে যতই সরল দেখাক এর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, তা বহু ভঙ্গিমা ও বৈচিত্র্যের অধিকারী। ”
তাঁর এ বিখ্যাত উপন্যাসটি প্রথমে মাসিক পত্রিকা মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকটি অধ্যায় মোহাম্মদীতে মুদ্রিত হবার পর উপন্যাসটির মূল পাণ্ডুলিপি রাস্তায় খোঁয়া যায়। বন্ধু-বান্ধব ও অতি আগ্রহী পাঠকদের আন্তরিক অনুরোধে তিনি পুণরায় কাহিনীটি লেখেন। কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে যাবার আগে এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বন্ধু-বান্ধবকে দিয়ে যান।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামের এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই একটি মাত্র উপন্যাস লিখেই তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্মরণীয় প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
উপন্যাসের কাহিনীকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্রস্রষ্টা ঋত্বিক কুমার ঘটক ১৯৭৩ সালে তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহের কারণ হিসেবে ঋত্বিক কুমার ঘটক বলেন,“ তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খণ্ডজীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো – সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল। … অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে, ভেতর থেকে লেখা। আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুণর্জীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখাতে চাই যে, মৃত্যুর পরেও এই পুণর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।
স্বল্পকালীন জীবনে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এছাড়াও তিনি বহু শিশুপাঠ্য কবিতাও রচনা করেছেন।বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোলেও চল্লিশের দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখের পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থ সিরিজ আকারে লিখে তিনি বিশেষভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিতাস একটি নদীর নাম তাঁর স্মরণীয় উপন্যাস।তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ হচ্ছে -• তিতাস একটি নদীর নাম (উপন্যাস)• এক পয়সায় একটি (গ্রন্থ)
• সাদা হাওয়া (উপন্যাস)• সাগরতীর্থে • নাটকীয় কাহিনী• দল বেঁধে (গল্পগ্রন্থ)• রাঙামাটি
• জীবনতৃষ্ণা (অনুবাদঃ লাস্ট ফর লাইফ)
অকৃতদার নিঃসঙ্গ অদ্বৈত বহু কৃচ্ছ্রসাধন ও উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যতটুকু আয়-উপার্জন করতেন তার অধিকাংশই ব্যয় করতেন দুঃস্থ পরিচিতজনদের মধ্যে। তাঁর গ্রন্থপ্রীতি ছিল অসাধারণ। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেও যথাসম্ভব বই কিনেছেন তিনি। আর্থিক সঙ্গতি কম থাকা স্বত্ত্বেও কলকাতার মালোপাড়ার শিশু-কিশোরদের ঘরোয়া বিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়োজিত উপেন্দ্রবাবুর স্বল্পশিক্ষিত বিধবা প্রফুল্লকে নিয়মিতভাবে আর্থিক সাহায্য করতেন।
মাত্র ৩৭ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীপাড়ার নিজ বাড়ীতে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মৃত্যুবরণ করেন।
৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১লা জানুয়ারি, ২০১২ইং, রবিবার, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার গোকর্ণঘাটে অদ্বৈত মল্লবর্মণের পৈতৃক বাড়ীতে আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নানের উদ্যোগে এবং জেলা পরিষদের অর্থায়নে এটি নির্মিত হয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা রামমোহন লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষের কাছে যাবতীয় গ্রন্থরাজী তুলে দেন সদ্ব্যবহারের জন্য। সাহিত্য, দর্শন ও চারুকলাবিষয়ক এমন সুচিন্তিত ও সুনির্বাচিত সংগ্রহশালা ছিল দুর্লভ। লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ এই সহস্রাধিক গ্রন্থ সংগ্রহশালা নিয়ে পৃথক একটি বিভাগ সৃষ্টি করে সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছেন।