সুমন নূর: ভয়াল টর্নেডোর থাবায় ক্ষতবিক্ষত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুরু হয়েছে মানবিক বিপর্যয়। ধ্বংসলীলার তৃতীয় দিনও সর্বস্ব হারানো মানুষের মধ্যে জরুরি খাদ্যসাহায্য পাঠানো যায়নি। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পর্যন্ত সরবরাহ করা যায়নি সেখানে। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে রাস্তাঘাট-আঙিনা জুড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে চুরিচামারি-লুটপাটের ঘটনায় রীতিমতো ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ শুরু হয়ে গেছে। এদিকে আজ টর্নেডো-বিধ্বস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস-সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, বেলা ৩টায় শেখ হাসিনা সেখানে পেঁৗছবেন। সেখানে তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেবেন। টর্নেডোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। টর্নেডো ক্ষতিগ্রস্ত এ জেলার ২১টি গ্রামের মধ্যে চিনাইর সবচেয়ে বেশি লণ্ডভণ্ড হয়েছে। সেখানে মারা গেছেন অন্তত আটজন। টর্নেডোর ছোবলে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, অন্যান্য জরুরি জিনিস দূরদূরান্তে উড়ে গেলেও সেগুলো সংগ্রহের সুযোগ পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। টর্নেডো-বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনের নামে শত শত লোক সেসব দামি জিনিসপত্র রীতিমতো লুটপাট করে নিচ্ছে। বাধা দিয়েও ফেরানো যাচ্ছে না তাদের। এদিকে ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করে জানান, অনেক কষ্টেসৃষ্টে পুকুর-ডোবা, খেত-খামারে খুঁজে বাতাসে উড়ে যাওয়া কিছু জিনিস সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ঘরহীন বাড়ির ভিটেয় সেগুলো স্তূপ করে রাখলেও রাতে সবকিছু চুরি হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে গৃহবধূ ও যুবতীরা। রবিবার উড়শিউড়া, রামরাইল, চিনাইর, চাপুইরসহ অন্যান্য গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের দূরবর্তী স্বজনদের বাড়িঘরে আশ্রয়ের জন্য পাঠাতে দেখা যায়। সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল, ঢেউটিন, নগদ টাকা সহায়তা দেওয়া হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছে না। কারও বাড়িতে রান্না করার মতো চুলা নেই, হাঁড়ি-পাতিল, সরঞ্জাম নেই। এমনকি চুলা জ্বালানোর উপায় নেই। টর্নেডো বিধ্বস্ত ২১ গ্রাম ঘুরে কোথাও একটি টিউবওয়েল পর্যন্ত দেখা যায়নি। বেশ কিছু টিউবওয়েল দানবীয় বাতাসের থাবায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিছুসংখ্যক আবার পাইপসহ উঠে এসে জায়গা করে নিয়েছে গাছের ডালে। ফলে টর্নেডো-বিধ্বস্ত এলাকায় খাওয়ার পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। রবিবার পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালানোর দাবি করা হলেও সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণের দাবি করা হয়েছে। তবে সরেজমিন ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে ত্রাণসামগ্রী পেঁৗছানোর নজির পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে সমস্যা, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বানের স্রোতের মতো বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী হাজির হচ্ছে। দর্শনার্থীদের ভিড়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা মানুষজন, বিশেষ করে মহিলারা হচ্ছেন বিব্রত। উপদ্রুত এলাকায় সরেজমিন : টর্নেডো-বিধ্বস্ত চান্দি, উরশিউড়া, জারুলতলা, আমোদাবাদ, ভাতশালা ও ফুলবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন বাতাসে উড়ে যাওয়া জিনিসপত্র কুড়িয়ে জড়ো করছে। বাড়িঘরে আবর্জনাও অপসারণের চেষ্টা করছে তারা। ভাঙাচোরা শত ছিদ্রের টিন জড়ো করে কোনোরকমে ঠেকনা দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানানোর কাজে পুরুষদের ব্যস্ত দেখা যায়। চান্দি গ্রামের গৃহবধূ হাসনাহেনা, সুরাইয়া বেগম, হেলা বেগমসহ কয়েকজন জানান, তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। বাড়িতে ঘর, গাছপালা বলতে অবশিষ্ট নেই কিছু। পল্লী বিদ্যুৎ থেকে লোকজন এসেছিল। কবে নাগাদ লাইন সচল করা যাবে সে ব্যাপারে তারা কিছু বলেনি। বিদ্যুৎকর্মীরা শুধু মিটারগুলো খুলে নিয়ে গেছে। ভাতশালা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার, মিটার, ট্রান্সফরমার এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। গৃহবধূ লাকী আক্তার বলেন, ‘নিজের বাড়িও শেষ, শ্বশুরবাড়িও শেষ। বাতাসে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোথাও দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই আমার।’ লাকী জানান, স্বামী চড়া সুদে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করছেন। চার সন্তান নিয়ে এখন লাকী চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। চান্দি গ্রামের হেলাল মিয়া জানান, ‘বোনের স্বামীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করে ফিরে এসে দেখি অবহেলা আর চিকিৎসাহীনতায় বোন আরশেদা বেগম (৪০) মারা গেছেন।’ ফুলবাড়িয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, রবিবার দুপুর পর্যন্ত তারা সরকারি কোনো ত্রাণ পায়নি। এমনকি কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি। শুক্রবার বিকালে সদর উপজেলার উড়শিউড়া, রামরাইল, চিনাইর, চাপুইর, আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলার ২১টি গ্রামে এখন বয়ে যাওয়া টর্নর্েডোর হতাশার ছাপ। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা ও আহতদের সুচিকিৎসা, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ ও জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া, সবকিছু তাদের বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে। সরকারি হিসাবে পাঁচ শতাধিক মানুষ গৃহহীন হওয়ার হিসাব করা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। রেড ক্রিসেন্ট থেকে কিছু তাঁবু কয়েকটি পরিবারকে দেওয়া হলেও সবার ভাগ্যে তা জোটেনি। ধ্বংসলীলা থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, রেলস্টেশন রেহাই পায়নি কিছুই। ত্রাণ নিয়ে যা হচ্ছে : টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে চলছে তেলেসমাতি কারবার। ক্ষতিগ্রস্ত ২১ গ্রামের মধ্যে চিনাইরে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোক্তাধির চৌধুরীর বাড়ি। তাই প্রশাসন ও বিতরণকারীরা তাদের সন্তুষ্টির জন্যই বেশি বেশি ত্রাণ চিনাইরের দিকেই নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। তোলা হচ্ছে চাঁদা। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দুটি মাইক দিয়ে অবিরাম সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে। গ্রামে যেসব দর্শনার্থী যাচ্ছে তারাও পকেট থেকে নিজের মতো করে নগদ টাকা-পয়সা দিচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ চাঁদা উঠেছে এর হিসাব মেলেনি। ক্ষতিগ্রস্ত চান্দি এলাকার মানুষ বলছে, ‘এ গ্রামে মন্ত্রী-এমপি না থাকায় আমরা ত্রাণ পাচ্ছি না।’ মানুষ মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণ : বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রবাসীকল্যাণ সম্পাদক সৈয়দ এমরামুজ্জান ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করে জানান, বেগম জিয়ার নির্দেশে তিনি এসেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক নূর মোহাম্মদ মজুমদার সদর হাসপাতালে ৭৫ জনকে নগদ ৫ হাজার টাকা বিতরণ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন ক্ষতিগ্রস্তদের সরেজমিন দেখতে সদর হাসপাতালে আসেন। কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মইন উদ্দিন মইন সিনিয়র নেতাদের নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। জেলা পুলিশের উদ্যোগে সুপার মনিরুজ্জামান ও অতিরিক্ত সুপার জাহিদুল ইসলাম চিনাইর চান্দি গ্রামে ত্রাণ বিতরণ করেন। কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ফজিলাতুন নেছা বাপ্পী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। দুর্গত এলাকায় এরশাদ : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্ত বাসুদেব ইউনিয়নের চান্দি গ্রাম ও পরে জারুলতলা পরিদর্শন করেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থি ছিলেন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া, মেজর (অব.) খালেদ, সেলিম মাস্টার, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান বশির উল্লা জরু প্রমুখ। পরে এরশাদ ক্ষতিগ্রস্ত চান্দি গ্রামের নারী-পুরুষের মধ্যে শাড়ি, লুঙ্গি ও শুকনো খাবার বিতরণ করেন। |