Main Menu

মতিনের কাছে হার মেনেছে অন্ধত্ব আর দারিদ্র্য

+100%-

matinডেস্ক ২৪:: জন্মান্ধ মতিনকে ছোট বেলা থেকেই প্রতিটি পদে পদে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। পৃথিবীর রঙ তার দেখা হয়নি, কিন্তু মানুষের রঙ ঠিকই বুঝতে পেরেছে সে। পড়ালেখার সময় সে পেয়েছে নানা ধরণের মানুষ। সেসব মানুষ, সহপাঠী আর সংগঠনের ভালোবাসার কারণে দৃষ্টিহীনতা ও আর্থিক অস্বচ্ছলতা হার মেনেছে তার কাছে।

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মতিনের নানা কারণে পড়ালেখা শুরু করতে দেরি হয়েছে অন্যান্য সমবয়সী ছেলেমেয়দের চাইতে। তীব্র প্রচেষ্টা আর পড়া লেখার প্রতি আগ্রহের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক, সংগঠনের সহায়তায় জায়গা করে নিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সে।

মো. মতিন মিঞার জন্ম ১৯৯৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর থানার সলিমাবাদ ইউনিয়নের আশরাফবাদ গ্রামে। পিতা মো. আলী মিঞা এবং মাতা নূরজাহান বেগমের চার সন্তানের মধ্যে সে তৃতীয়।

ছোটবেলা থেকেই পড়ার প্রতি তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। বোন যখন ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতো তা সেখান থেকে শুনেই সবকিছু মুখস্ত করে ফেলতো মতিন। এছাড়া ছোট বেলায় গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও স্যারদের ক্লাসে পড়ানো শুনেই সবকিছু মুখস্ত করে ক্লাসেই বলে দিতো। এই রকম প্রতিভা দেখে ক্লাসের ম্যামরাও তাকে অনেক বেশি আদর করতো।

মতিনের ছোট বেলায় শখ ছিল মাদরাসায় পড়ার। এজন্য অনেক ঘুরেছেও সে। কিন্তু অন্ধদের জন্য মাদরাসায় পড়ার ব্যবস্থা না থাকার কারণে মনে কষ্ট নিয়েই তাকে ফিরে আসতে হয়েছে।

পরে কোথাও যখন পড়ার ব্যবস্থা করতে পারছিল না ঠিক সে সময় সিবিআর নামক অন্ধদের পূনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্পের সহায়তার অ্যাসিস্টান্স ফর ব্লাইন্ড চিল্ড্রেনের সার্বিক সহযোগীতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখপড়াসহ থাকা-খাওয়ার সার্বিক ব্যবস্থা করে দিয়েছে অ্যাসিস্টান্স ফর ব্লাইন্ড চিল্ড্রেন নামক সংগঠনটি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাশ করে মতিন। এরপর কোন কূলকিনারা পাচ্ছিল না। কোথায় ভর্তি হবে, কে টাকা দেবে, কোথায় থাকবে? কারণ এসএসসি পাশের পর তাকে অ্যাসিস্টান্স ফর ব্লাইন্ড চিল্ড্রেনের মেস থেকে বের হয়ে আসতে হয়। আর ঠিক সে সময় সে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বৃত্তি পায় সে। কথা বলার সময় সে বার বার বলেছে এই বৃত্তি না পেলে তার জীবনের হয়তোবা অনেক কিছুই করা সম্ভব হত না।

মতিন জানায়, ‘এইচএসসিতে সবকিছু রেকর্ড করে নিতে অনেক কষ্ট হত। এ সময় একটু লাগাম ছাড়া হওয়ায় পরীক্ষা দেওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর ডিগ্রী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আফসানা ম্যাম সবচাইতে বেশি সহায্য করেছে। কলেজের টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারিনি, কিন্তু ম্যাম ব্যবস্থা করে দেন’। পরীক্ষা না দিতে পারলে আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা হতো না বলেও জানায় সে। পরে সেখান থেকে এইচএসসি পাশ করে মতিন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়ও অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় মতিনকে। এইচএসসি পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার মত কেউ ছিল না। ‘ভাগ্যিস ব্রাহ্মবাড়িয়া থেকে যে সব ভাইয়েরা পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাদের ফোন নম্বর পেয়েছিলাম’ জানান মতিন।

অবশ্য বড় ভাইদের অনেকেই মতিনের রেজাল্ট শুনে একটু অখুশি হন, এরকম রেজাল্ট সাধারণত হয় না বলে তারা মতিনকে জানান। তারা আরো বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম তোলার মত পয়েন্ট তার নেই। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম তুলতে পারবে।

অবশ্য মতিন এটা শুনেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে কারণ অন্তত একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ফর্ম তুলতে পারবে।

ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তার মাঝে হঠাৎ একদিন এক শুভাকাঙ্খী মতিনকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি গাইড রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভর্তির সুযোগ পায় জাবি’র ইতিহাস বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে ভর্তি হয় জাহাঙ্গীরনগরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও মতিনকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি যুক্ত হয় বইয়ের সমস্যা। যখন স্যারদের দেয়া ডজন ডজন বইয়ের লিস্টের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলো সে, তখন তার সাহায্যে এগিয়ে আসে একই বিভাগের মেহেদী হাসান। তিনি মতিনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। কখনো টেপ রেকর্ড করে, কখনো বা ব্রেইল পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে, এভাবেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে সে।

মতিন জানায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন থেকেই বন্ধুদের অনেক সহায়তা পেয়েছি। সত্যি কথা বলেতে গেলে বন্ধুদের নানা রকম সহযোগীতা না পেলে আজ চতুর্থবর্ষ পর্যন্ত আমি আসতে পারতাম না। আমার জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সহায়তা অনেক বেশি’।

মতিনের ইচ্ছা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে সমাজের সুবিধা বঞ্চিতদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিবেন। আত্মনিয়োগ করতে চান সমাজ কর্মে।সূত্র: জাগো নিউজ






Shares