Main Menu

পলুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের আবাস পাচ্ছি:: একিউএম সফিকুর রউফ (শহীদ পলুর ভাই)

+100%-

poloআজকের এই ৬৪টি জেলার একটির নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া! এর পেছনের ইতিহাস হয়তো অনেকেরই মনে নেই। মনে না থাকারই কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু উদ্যোগী তরুণে উৎসাহে আজ তুলে ধরার তার কিছু স্মৃতিকথা! আজ সবাই আমরা জেলার বাসিন্দা বলে অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি, গর্ব করছি ঐতিয্যের, চেষ্টা করছি এর উন্নয়নের, একটি মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, সুন্দর সুফলা সুজলা জেলা হিসেবে কিভাবে তুলে ধরা যায় বিশ্বের দরবারে সুযোগ খুজছি। আর এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের এই আপ্রাণ চেষ্টা। এই স্বপ্নকে লালন করেছিল পলু – এ কে এম ওবায়দুর রউফ পলু! আর নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে এ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে সুন্দরতম করতে আমাদের কত দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়ে গেছে। আমি এর ভাই হিসেবে বলতে চাই আজকের এই তরুণদের একটি উদ্যোগী দল জেলাকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছে, শুনে আমার মন ভরে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় লেখার ক্ষুদ্র প্রয়াস আমার এ লেখা ।

পরপর তিনটি গুলির শব্দ! ভিতরটা কেন জানি না ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো। দাড়িয়ে ছিলাম কালিবাড়ি মোড়। শুনলাম মিছিলটি স্টেশনে দিকে গেছে। ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বরের কথা। তৎকালিন প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের আমলের কথা। ঘন ঘন একটু কিছুতেই ইউনিভার্সিটিগুলো বন্ধ করে দিচ্ছিল। ২৭ শে নভেম্বরের ঠিক আগের দিন দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে ধাবিত হলে অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে ভুক্তভোগিদের ন্যায় বাংলাদেশ কৃষিবিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র হিসেবে চলে আসতে হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আমার ছোট ভাই আ ন ম মুজিবুর রউফ তখন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (পরবর্তিতে চট্টগ্রাম বিআইটি) ছাত্র। সেও চলে এলো বাড়িতে। পলু তখন এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষেও ছাত্র। সামনে পরীক্ষা। সবাই যখন বাড়িতে এসে জড় হলাম তখন আমরা সবাই যেন নিরাপদ বোধ করলাম। আমার মা যেন হাফ ছেঁড়ে বাচলেন। কিন্তÍু তখন জেলা করার দাবিতে সোচ্চার জেলার ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগন, জেলা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মাইকে বলা হলো আগামী কালের আন্দোলন কর্মসূচি। মনে মনে ভালো লাগলো। মহকুমা শহর হবে জেলা – কত আনন্দের! পলুর মনে যে কি বীজ বপন হয়েছিলো – আমরা তার ঘুণাক্ষরে টের পাইনি। সন্ধ্যার আগেই আমাদের বাড়ির সবাই বাইরে থেকে ঘুরে বাড়িতে চলে আসলো নির্ধারিত সময়ের আগেই। বাইরের অবস্থা বেশী ভালো না তাই। তবে সবকিছুই চলছিলো শান্তিপূর্ণ ভাবেই। এদিকে পলুর সামনে পরীক্ষা , তার পড়া তৈরী করতে হবে। সে ও চলে আসলো সন্ধ্যার আগে। বলে রাখা ভালো যে, আমার মা- বাবা দুজনই বেশ কড়া মেজাজের ছিলেন, পড়ার ক্ষেত্রে কোন ছাড় ছিলো না তাদের। বাড়িতে আর যারা ছিলো তারা সবাই বিভিন্ন ক্লাসে পড়তো। বর্তমানে তারা কেউ প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা, ইঞ্জিনিয়ার, আর আমি ছিলাম একজন কৃষিবীদ ও প্রাণি বিজ্ঞানী।

সেসময়কালে আমাদের বাড়ির একটা সুনাম ছিলো পড়ালেখার জন্য। সবাই আমরা পড়ায় ছিলাম-শুধুমাত্র বড় ভাই ছিলেন পিডিবির এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারিং। তৎকালিন সময়ে উনি ঘোড়াশাল ছিলেন পরিবার নিয়ে। পরবর্তিতে তিনি পিডিবির চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বড় আপা ছিলেন ঢাকায়। উনি ছিলেন আইসিডিডিআরবি-ও একজন এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার। আর আমি আর আমার ছোট ভাইটি বাদে সবাই থাকতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। একজন পুলিশ অফিসারের সন্তান হয়ে আমরা এ পর্যায়ে থাকবো – তা কেউ চিন্তটি পর্যন্ত করেনি। আমার বাবা এ এস এম আবদুর রউফ ছিলেন একজন সৎ নিষ্ঠাবান চট্টগ্রাম ডিএসবি-র ওসি। আব্বার সততার জন্য আমরা আজও গর্ব করে চলি। আমরা দেখেছি – আমার বাবাকে কত না কষ্ট করে আমাদেরকে চেষ্টা করেছেন সৎ শিক্ষিত মানুষ হিসেবে তৈরী করার। পলু আমাদের ৬ ভাই, ৫ বোনের মধ্যে ষষ্ট এবং শুধুমাত্র ভাইদের মাঝে চতুর্থ।
তিনটি গুলির শব্দ আমার ভিতরটা কেঁপে উঠলো। কালিবাড়ি মোড়ে দেখলাম কেমন জানি হতাশা সবার মাঝে। সবারই দৃষ্টি রেল ক্রসিং এর দিকে। ওই দিকেই গেছে মিছিলটি কিছুক্ষন আগে। পরে শুনলাম মিছিলটি রেল স্টেশনের দিকে রওনা দিয়েছ্।ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আমিও আর এগুতে চাইনি। থেমে গেলাম কালিবড়ি মোড়ে। হঠাৎ খবর এলো- একটি ছেলেকে পুলিশ গুলি করেছে, ছেলেটা সম্ভবত মারাও যেতে পারে। হঠাৎ দেখলাম আমার ছোট ভাই মুজিবুর রউফের স্কুল জীবনের বন্ধু রফিক দৌড়ে আসছে এবং কাঁদছে আর বলছে মাইরা ফালাইছেরে, মাইরা ফালাইছে। টেনশান নিয়ে একটু এগিয়ে গেলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো – দাদা পলুর গুলি গায়ে লাগছে, আল্লাহ কইতে পারে কি অইছে !!! আমার শরীর যেন অবশ প্রায়। আমি যেন পড়ে যাচ্ছি। কি হলো আমার ! আপন ভাই বলেই হয়তো আত্মিক টানে ভিতরটা পুড়ে উঠছিলো বারবার। এর কিছুক্ষনের মধ্যে আহত কি না নিহত (তখনও বুঝা যায়নি তার অবস্থা) পলুকে নিয়ে অনেকেই হাসপাতালের দিকে ছুটছে। রিক্সায় দুজনের কোলে পলু। এগিয়ে গেলাম দেখতে। উত্তেজিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগন এমনই ভাবে ঘিরে ধরে চলছিল আমি আর পারলামনা কাছে ভিড়তে। আমার মনে হচ্ছিলো পড়ে যাচ্ছি। সে (রফিক) আমাকে ডান হাতটা কাধে তুলে তার বা হাতটাকে আমার কাধে তুলে দিয়ে একরকম টেনেটেনে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়। পৌঁছে দেখি পলুকে ইমারজেন্সি বিভাগের ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার খুজছে। আমাকে এরকম চেপে ধরে চেয়াওে বসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে অনেকেই, কাউকেই আমি মনে রাখতে পারিনি। তারা সবাই আমাদের পরিবারকে করে রাখলো চিরঋনি। ডাক্তার এসে তার পালস চেক করে যখন বললো পলু আর নেই, সবাই স্বরস্বরে বলে উঠলো- ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। তখন যেন আমার মাথায় বাজ পড়লো, থ হয়ে রইলাম। কথা যেন বেড় হচ্ছেনা, হয়ে রইলাম স্তব্ধ, মুক। উত্তেজিত জনগনের চোখে যেন আগুন ছিটকে বেড় হতে লাগলো । কি করবে! তখন যেন তাদের দিশা নেই। উত্তেজনা যেন বেড়ে গেল আরো অধিকতর হারে। এক পর্যায়ে ট্রেচারসহ লাশ নিয়ে মিছিলে বেড়িয়ে পড়লো উপস্থিত জনতা। আমি আমার শরীরকে শরীরের মধ্যে পাচ্ছিলাম না। চোখ দিয়ে অজোর ধারায় যেন বন্যার পানি বের হতে লাগলো। শরীরটা সত্যিকার ভাবেই অবশ হয়ে আসছিলো। পড়েই যাচ্ছিলাম। একটু রেস্ট নিয়ে রফিকদের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পথে আব্বাকে দেখলাম উ™£ান্তের মতোন ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালের দিকে। হয়তো খবর পেয়েছেন কারো কাছে, তখনতো আর মোবাইল ছিলো না। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলাম আব্বাকে। আব্বার মুখে কোন কথা নেই, ভিতরটাতে যে ঘুর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম উনার বুকে যখন মাথা রেখে কাঁদতে থাকলাম। অধিক শোকে যে পাথর হয় বলে যে কথা প্রচলিত আছে তা তখনকার আব্বার অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম। ফিরে এলাম আব্বাকে নিয়ে বাড়িতে। তখনও লাশ পৌঁছেনি বাড়িতে। অপেক্ষার পালা । লাশ বাড়িতে এলো ঘন্টা দেড়েক পর । শুনলাম লাশ নিয়ে ব্যাপক মিছিল হয়েছে, হয়েছে মিটিং, আর লাশের মিছিল থেকে ঘটেছিলো উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ। তখন স্থান কাল পাত্র ভেদে সবাই এলো আমাদের শান্তনা দিতে। আমার যদ্দুর মনে পড়ে কোন পার্টিরও বাছবিচার ছিল না । দেখলাম দিলারা হারুন আপাকে, মাহবুবুল হুদা ভাইকে, জোবায়ের ভাইকে, বাক্কী ভাই ও তার দলবলকে দেখলাম। দেখলাম আরো নাম না জানা অনেক ভাইকে যারা আমাদের পরিবারকে আজীবন ঋণী করে রেখেছেন । কৃতজ্ঞ আমরা সবার কাছে যারা এসে আমাদের শান্তনা দিয়েছেন, আমাদের সহমর্মিতায় একাত্ব হয়েছেন।
বিকেলে জানাজা হয়েছিলো টেংকের পাড় মসজিদের সামনের মাঠে। খুবই তাগাদা ছিলো জানাজা শেষ করে দ্রুত শেরপুর কবরস্থানে দাফন করার জন্য। কারণ সন্ধ্যের পর কারফিউ! যেকোন সময় যাকে পাবে তাকেই ধরে নিয়ে যাবে তাই ভীষন হুরোহুরী। এধরণের মৃত্যুতে লাশের পোস্টমর্টেম করার বিষয় জড়িত। কিন্তÍু জনতার ক্ষেভের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাছে ভিড়তে পারেনি। তাই পোস্টমর্টেম ছাড়াই তাকে প্রথমে দাফন করা হয়েছিলো। ফিরে এসেও আম্মাকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না । আম্মা আমাদের জড়িয়ে ধরে ক্রমাগত কাঁদতে থাকলেন এবং বিলাপ করতে থাকলেন। মন আমাদের ভিষণ খারাপ। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। আশেপাশের অনেকেই আমাদের এসে শান্তনা দিচ্ছিলেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এলো। সব দরজা জানালা ভয়ে বন্ধ করে আমরা সবাই ঘরে বসে রইলাম। হঠাৎ দরজায় টোকা দিলে দরজা খুলে দেখি বাহার ভাইয়ের আব্বা (টেংকের উত্তরপাড় মসজিদের মুয়াজ্জিন বাহার ভাইয়ের আব্বা, যিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্মৃতি স্তম্ভের কাছাকাছি রেকটো নামের একটি পত্রিকা বিতরণকারী দোকানে কাজ করতেন, তিনি এসে ঘরে ঢুকে আব্বাকে বললেন বাইরে আর্মি, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক দাড়ানো আছে, আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে বলার জন্য যে, পলুর লাশ তুলে পোস্টমর্টেম করতে হবে, আপনাকে যেতে হবে। যদ্দুর মনে পড়ে – প্রথমে আব্বা আপত্তি করেছিলেন এই ভেবে যে, আমার বুকের ধন আমি নিজের হাতে শুইয়ে দিয়ে এসেছি আমি আবার তাকে দেখলে বাঁচব না, তাহলে আমার লাশটাকে আমার বুকের ধনের সাথে এক কবরে শুইয়ে দিতে হবে। অনেক শান্তনা দেওয়ার পর আব্বাকে আর্মির গাড়ি দিয়ে কবরস্থানে নিয়ে যায়। আমাদের আর কাউকে নিতে দেয়নি। কবরস্থান থেকে পলুকে তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে নিয়ে পোস্টমর্টেম করে। আব্বা এলে পরে জানলাম যে, উনি অতি কষ্টে পোস্টমর্টেম করার সময় ছিলেন।
যাই হোক এর পরপরই এরশাদ সাহেব ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করেন। তখন হলো ৬৩ টি জেলা ঘোষণা। পরবর্তিতে আরো একটি যুক্ত হয়ে এর সংখ্যা দাড়ায় ৬৪ তে। আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আপামর জনসাধারণ পেলো একটি নতুন জেলা! প্রত্যেকেই এখন জেলার সুবিধাদি ভোগ করে চলেছেন। আমরাও সবার সাথে রয়েছি দুঃখ-কষ্টে আস্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। পলুর জন্যে কোর্ট রোডের রাস্তাটির নাম এখন পলু সড়ক হলেও এখনও এ রোডের সাইনবোর্ডগুলোতে পলুর নাম লেখা হয়নি পুরোপুরি। পলুর অবদানের স্বীকৃতিতে শুধুমাত্র একটি রোডের নাম দিয়ে ক্ষান্ত হবো?
আমি জেনে খুশি হয়েছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টগবগে শিক্ষিত জোয়ানরা সামনে এসেছে ‘আমরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামে অরাজনৈতিকভাবে একতাবদ্ধ হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য মহৎ বলে আমার মনে হয়েছে। দলবদ্ধভাবে কাজ রলে আমি আশা করি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, সন্ত্রাস মুক্ত ও মাদকমুক্ত, হানাহানী ও ভেদাভেদমুক্ত সভ্য সমাজ গড়ে উঠবে। পলুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। আমাদের পরিবার সব সময় কাছে আছে। প্রয়োজনে আমাদের পরিবারের সকল সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উন্নয়নে মেধাশক্তি দিয়ে বা উপদেশ দিয়ে সুন্দর এক ব্রাহ্মণবাড়িয়া তৈরি করতে সদা সচেষ্ট থাকবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে আমার লেখা এখানে শেষ করছি।






Shares