Main Menu

জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তা

+100%-


ডেস্ক টোয়েন্টিফোর : দেশে এখন খুনের পর খুন হচ্ছে, আসামিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশ ঘটনার কোনো ক্লুই উদ্ধার করতে পারছে না। ফলে দেশজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে আতঙ্ক। নিরাপত্তাহীনতার জালে আটকা পড়ছে সাধারণ মানুষ। গত শনিবার রাতে খুন হন সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই আহমেদ মিরাজ। তার লাশ পাওয়া যায় রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় রাস্তার ওপর। একই দিন কুষ্টিয়ার লালন শাহ সেতুর নিচ থেকে পাওয়া যায় পাবনার বিএনপি নেতা ইব্রাহীম আলী মৃধার মৃতদেহ।  চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ডাকাতদের গুলিতে নিহত হয় তরুণী রেহানা আক্তার। খুলনার কয়রায় জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহত হন এক পুলিশ কনস্টেবল। এর আগের দিন গত শুক্রবার উদ্ধার হয় নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ওরফে ত্বকির মরদেহ। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে খুন হয় কালাম উদ্দিন নামের এক যুবক। চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী পেয়ারুল ইসলাম এবং রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র তারিকুল আলম। এছাড়া গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর সারাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৭৮ জন। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী এ বছরের দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) দেশে ৬২৭টি খুন হয়েছে। অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছে ১৬৭ জন। আর ডাকাতি হয়েছে ১১৮টি। অপরাধের এ হার আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

সব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় একের পর এক প্রাণহানিতে জনমনে নিরাপত্তার অভাব প্রকট হচ্ছে। একই সঙ্গে শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে গুম, অপহরণ, ডাকাতি ও নীরব চাঁদাবাজির মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের ঘটনায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।  বৈঠকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে এ ধরনের কোনো অভিযানের খবর শোনা যায়নি। উল্টো পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। কয়েক মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পাশাপাশি সরকারের শেষ সময়ে এসে দায়িত্ব পালনে পুলিশের শিথিলতার ফলে দেশ এখন এক ভয়াবহ সংকটে। ফলে সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, তাদের ওপরও আসছে আঘাত। সেই সঙ্গে বেড়েছে সংঘাত, সহিংসতার সঙ্গে নিরীহ মানুষ খুনের সংখ্যা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন। পরিস্থিতি আজ এতটাই উদ্বেগজনক যে, সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। আমরা মনে করি, রাজনীতির জন্য সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে না।

মানুষকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। এখানে যে কোনো ধরনের গাফিলতি পরিস্থিতিকে আরো সংকটময় করে তুলবে। চলমান সংকট সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সময় নষ্ট করা সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে। তাই উদ্যোগটা এখনই নিতে হবে। সেই সঙ্গে আমরা মানবতাবিরোধী মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা জোরদারে সাক্ষী ও তাদের পরিবারের সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি জানাই।  পৃথিবীর বহু দেশে স্পর্শকাতর মামলার সাক্ষী ও তাদের পরিবারের সুরক্ষায় আইন থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো আইন নেই। আমরা মনে করি, গোলাম আযমের মামলার প্রসিকিউশনের ১৪তম সাক্ষী বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোটভাই আহমেদ মিরাজ এবং এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া ওয়াহিদুল আলম জুনুর রহস্যজনক মৃত্যুর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে ওঠা এ দাবির প্রতি সমর্থন বাড়ছে। তাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত ইতিহাসের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো অতিস্পর্শকাতর মামলার সাক্ষীর সুরক্ষায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ের করা মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, বিশেষ করে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের অনেকেই এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আহমেদ মিরাজ নিহত হওয়ার পর সাক্ষীদের পরিবারের সদস্যদেরও নিরাপত্তা হুমকির মুখে। মিরাজ ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই। গত শনিবার গভীর রাতে রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া একজনের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বা তাদের পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্তদের মিলিয়ে এ পর্যন্ত সাতজনকে দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন করা হয়েছে। হামলা চালিয়ে আহত করা হয়েছে অন্তত ২০ জনকে। যুদ্ধাপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা যদি এভাবে খুন হতে থাকেন এবং অন্য সাক্ষীদের পরিবার যদি আতঙ্কে দিন কাটাতে থাকেন, তাহলে তো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে আর সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এ কারণেই অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কাছে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হচ্ছে। সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হলে সাক্ষী এবং তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার আইনি ভিত্তি তৈরি হতো। সাক্ষীদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত আস্তাহীনতা দূর হতো। বিভিন্ন মহল মনে করছেন, সরকার পরিবর্তন হলে সাক্ষী এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের ওপর আবার প্রতিশোধ নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য হলো, সরকার যদি সত্যিকার অর্থেই মানবতাবিরোধীদের বিচার ও সাজা দিতে চায়, তা হলে তাকে এ মুহূর্তেই সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, গোটা বিষয়টিই সরকার আমলে নিচ্ছে না। শুধু সাক্ষ্য প্রদানকালে সাক্ষীদের সেফহোমে রেখে নিরাপত্তা দিলেই চলবে না, পরবর্তী পর্যায়ে সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সরকারকেই দেখতে হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-শিবির সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।  সুতরাং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নারকীয় ভূমিকার পুনরাবৃত্তি এদের দ্বারাই সম্ভব। শুধু সাক্ষীদের হত্যার প্রশ্নেই নয়, জামায়াতবিরোধী যে কোন উদ্যোগকেই তারা সহিংসভাবে মোকাবিলা করার রাজনৈতিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এরই ফল হিসেবে সাতটি প্রাণ ঝরে গেল।

সর্বশেষ খুন হলো নারায়ণগঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তার কিশোর ছেলে ত্বকি। এদের নিরাপত্তাদানের পাশাপাশি, সরকারকে আর কাল বিলম্ব না করে অচিরেই ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে চোখ বুঝে থাকার কোন অবকাশ নেই। জামায়াতের সহিংস নীলনকশা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সরকারকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আত্ববিশ্বাস থাকা ভালো। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তারও যে একটা সীমারেখা রয়েছে সরকারকে তাও ভাবতে হবে। সুতরাং এখনই ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করা হোক। তা না হলে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়ার হুমকিতে পড়বে।






Shares