Main Menu

বাংলাদেশে সমাধি চান পাকিস্তানের ‘উজির-এ-খামাখা’

+100%-

উজির-এ-খামাখা’- এ নামেই তাঁকে বিদ্রূপ করত পাকিস্তানের লোকজন। তবে এখন আর তিনি কোনো আলোচনায় নেই। নিজ দেশ বাংলাদেশেও তিনি ঘৃণিত, নিন্দিত ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়াই শুধু নয়, ওই ভূখণ্ডে চলে গিয়ে রীতিমতো একজন পাকিস্তানি হিসেবে আত্মপরিচয় সৃষ্টির কারণে। তাঁর নাম ত্রিদিব রায়। সাবেক এই চাকমা রাজাকে বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত করার ইচ্ছাসংবলিত একটি পরোক্ষ আবেদন আট বছর ধরে ঝুলে আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ত্রিদিব রায় নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে বাংলাদেশে ফেরার সুযোগ পেতে পারেন।

স্থানীয় একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মতে, মানবিক দিক বিবেচনা করে ত্রিদিব রায়ের আবেদনের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পাকিস্তান সরকার গত আট বছরে একাধিকবার বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় বাংলাদেশ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এমনকি কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতেও অনীহা প্রকাশ করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট অন্য সূত্রগুলোর মতে, রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়ে তাঁর ভূমিকার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে ওই আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে।
অবশ্য ত্রিদিব রায় নিজে সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের কাছে ওই আবেদন করেননি। পাকিস্তান সরকারকে লেখা তাঁর একটি চিঠির অংশবিশেষ উল্লেখ করে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে ২০০৪ সালে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বার্তায় ওই আবেদন করা হয়েছিল। এর পর থেকে তা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। পাকিস্তানের জনগণ ওই মর্যাদা দেওয়ার বিষয়কে বিদ্রূপ করে তাঁকে ডাকত উজির-এ-খামাখা বলে। তবুও তিনি ১৯৭১ সাল থেকেই বিশেষ মর্যাদা নিয়ে পাকিস্তানে আছেন।
রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। ত্রিদিব রায়ের পর তাঁর বড় ছেলে ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় চাকমা রাজা হয়েছেন। তিনি মা ও বোনদের সঙ্গে দেশে থেকে গেছেন। ত্রিদিব রায় বর্তমানে পাকিস্তানে বসবাস করে তিনি ওই দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। তিনি মেঙ্েিকাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক নোট ভার্বালে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন পাকিস্তান সরকারের কাছে রাজা ত্রিদিব রায়ের লেখা চিঠির অংশবিশেষ তুলে ধরে। রাজা ত্রিদিব রায় তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন, পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কোনো সমাধিক্ষেত্র নেই। মৃত্যুর পর চাকমা ও বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্য ও রীতি অনুযায়ী তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে সমাধিস্থ হতে চান। চিঠিতে ত্রিদিব রায় আরো লিখেছেন, তাঁর মনে হয় না ওই ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কোনো আপত্তি থাকবে। তবে তিনি মনে করেন, মৃত্যুর পর রাঙামাটিতে তাঁকে সমাধিস্থ করার ক্ষেত্রে যে বাংলাদেশ সরকারের কোনো আপত্তি থাকবে না, তা আগেই নিশ্চিত হওয়া দরকার।
জানা গেছে, ত্রিদিব রায়ের বয়স বর্তমানে প্রায় ৮০ বছর। ২০০৪ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ত্রিদিব রায়ের ওই আবেদনের ব্যাপারে মতামত চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয়গুলো অভিন্ন কোনো মত দেয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে জানায়, ওই আবেদনের ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবেদনটি বিবেচনা করতে পারে।
অন্যদিকে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই ওই আবেদনের ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তবে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান রাজা ত্রিদিব রায়ের আবেদনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
এম মোরশেদ খান তাঁর মন্তব্যে লিখেছিলেন, রাজা ত্রিদিব রায়ের মরদেহ বাংলাদেশে সমাহিত করতে দেওয়া উচিত বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। এতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও পাকিস্তান খুশি হবে। আর তা বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাঠিয়ে পাকিস্তান যে শুভেচ্ছার নিদর্শন দেখিয়েছে, এর পূরক (রিসিপ্রোকেট) হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের পর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অন্তত চার দফা চিঠি তারা পেয়েছে। প্রতিটি চিঠিতেই রাজা ত্রিদিব রায়ের আবেদনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি।
মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বাংলাদেশ যে সময়ে (২০০৪ সালে) ওই আবেদন পেয়েছিল, পরবর্তী বছরগুলোতে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে।
বর্তমানে ওই আবেদন কী অবস্থায় আছে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তা ছাড়া দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ওই আবেদনের স্পর্শকাতরতা আরো বেড়েছে। ওই আবেদনের ব্যাপারে সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। রাজা ত্রিদিব রায়ও পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে দূতিয়ালি করেছেন। তিনি যদি তাঁর সেসব ভূমিকার জন্য ক্ষমা চান, তাহলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকার জন্য সেই আবেদন বিবেচনা করা সহজ হতে পারে।
২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় ‘অ্যা চাকমা ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানে ‘ঢাকার পতন’ দিবস পালনের প্রাক্কালে রাজা ত্রিদিব রায় ইসলামাবাদে দ্য হিন্দুকে বলেছেন, জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ওই সিদ্ধান্ত (১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করা) নেওয়ায় তাঁর কোনো অনুতাপ নেই, বাংলাদেশ এখনো তাঁর জনগণের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাচ্ছে।
দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে ত্রিদিব রায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, জমকালো ব্যক্তিগত জীবনের জন্য একসময় তাঁর সুনাম ছিল, বাড়িতে পার্টি দিতেন। এখন তিনি আগের জীবনের ছায়া হয়ে আছেন। আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সংবর্ধনা ছাড়া আজকাল রায় সাহেব অনেকটাই নিঃসঙ্গ। তবু তিনি এখনো বেশ চটপটে। সাধারণভাবে চলাফেরা করেন, গলফ আর ব্রিজ খেলেন। পাকিস্তানের ক্ষুদ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ আর ঘোরাফেরা করেন।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, রাজা ত্রিদিব রায় মানুষের মধ্যে প্রচলিত একটি ধারণার সংশোধন করতে চান। অনেকে মনে করে, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৬ ডিসেম্বর পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন বলে দাবি করেন। রাজা ত্রিদিব রায় দ্য হিন্দুকে বলেন, ‘ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার আমাকে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ডাকে। আমার ভূমিকা ছিল আসন্ন যুদ্ধের প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা।’
দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রথম দিকে রাজা ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৯৭২ সালে তিনি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্রিদিব রায়কে দেশে ফিরিয়ে আনতে রাজি করাতে তাঁর (ত্রিদিব) মাকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের অনুরোধেও তিনি আসেননি। পাকিস্তানের প্রতি এমন বিশ্বস্ততার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন।
১৯৭১ সালের পর আর বাংলাদেশে ফেরেননি রাজা ত্রিদিব রায়। দ্য হিন্দু পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি আমার মানুষ, বাড়ি আর সম্প্রদায়ের শূন্যতা অনুভব করি। কিন্তু পরিস্থিতি আর ইতিহাস আমার জীবনে বিশাল এক ভূমিকা পালন করেছে।’






Shares