Main Menu

ফরাক্কার পরে তিস্তায় আরও অনড় মমতা

+100%-

তিস্তা চুক্তি নিয়ে জল ঘোলা হয়েছিল আগেই। এ বার ফরাক্কা ব্যারেজ তাকে ঠেলে দিল বিশ বাঁও জলে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতেই শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি সই হয়নি। তাঁকে বোঝাতে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই। আগামিকাল, শনিবার বিকেল চারটেয় দু’জনের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে মাথাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝাবেন, তিস্তা চুক্তি না হলে বাংলাদেশকে ঘিরে নতুন করে ভূ-কৌশলগত ভাবে সমস্যায় পড়বে দিল্লি। এই মুহূর্তে তাই কূটনৈতিক দিকটির কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দু’টি স্লুইস গেট খারাপ হওয়ার জন্য ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে বাংলাদেশ বেশি জল পেয়ে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যে রিপোর্ট এসেছে, তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে। নিজের অবস্থানে মমতা আরও অনড় হয়েছেন। ফলে মাথাই আগামিকাল বোঝানোর চেষ্টা করলেও চুক্তির ভবিষ্যৎ আপাতত অনিশ্চিত বলেই আশঙ্কা রাজনৈতিক শিবিরের।
শুধু তিস্তা চুক্তিই নয়, মমতার তীব্র আপত্তিতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে আটকে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল হস্তান্তরও। মমতার বক্তব্য, এর ফলে রাজ্যের বেশি জমি চলে যাবে। আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি সেটা হতে দিতে পারেন না। দিল্লির যুক্তি, ছিটমহলের এই জমিগুলি ১৯৪৭ সাল থেকেই কোনও দেশ ব্যবহার করতে পারেনি। দু’দেশের ওই এলাকার মানুষও চান, ছিটমহল হস্তান্তর করা হোক। কিন্তু মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ বা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে না হলেও রাজ্যের ভাগের জল বা এলাকা কমে যাওয়া, কোনওটাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি নন। তাঁর যুক্তি, তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। নেহরুর কূটনীতি মেনে জমি দিয়ে শান্তি কেনার কথা তিনি ভাবতে যাবেন কেন?
এর মধ্যে এসে পড়েছে ফরাক্কা ব্যারেজ নিয়ে রিপোর্ট, যেখানে অভিযোগ, স্লুইস গেট খারাপ বলে বাংলাদেশকে অনেক বেশি জল ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রও প্রাথমিক ভাবে খতিয়ে দেখে একই কথা জানাচ্ছেন।
ফরাক্কার পরিস্থিতি কী? প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সেখানে গত বছর দু’টি স্লুইস গেট অকেজো হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ প্রায় ৮২ হাজার কিউসেক জল পেয়ে যায় গোটা বছরে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী তাদের পাওয়ার কথা ৩৫ হাজার কিউসেক জল। রিপোর্টে আশঙ্কা, এই হারে জল বেরিয়ে গেলে জলের স্তর এতটা নেমে যাবে যে এনটিপিসি-র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। যার ফলে রাজ্য জুড়ে বিদ্যুৎ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেবে।
এই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেই মমতা ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, আমরা তো জল পাচ্ছিই না। আগামিকাল রঞ্জন মাথাইয়ের সঙ্গে বৈঠকেও যে এর ছাপ পড়বে, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবির প্রায় নিশ্চিত। ফরাক্কা বাঁধ প্রকল্পের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এসে এর মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দিয়েছেন রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। গত কাল মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বৈঠক করেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র এবং সেচসচিব অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই বৈঠকটি ছিল মাথাই-মমতা বৈঠকের প্রস্তুতি।
তবে আগামিকাল বৈঠকে মমতাকে বোঝানোর সব রকম চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রীর দূত মাথাই। তাঁর তথা দিল্লির প্রধান যুক্তি, বর্তমানে বাংলাদেশের যা রাজনৈতিক অবস্থা, তাতে এই চুক্তি সম্পাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা সরকারের বয়স প্রায় তিন বছর। সরকার বিরোধী হাওয়ায় এখন সেই সরকারের অবস্থা যথেষ্ট নড়বড়ে। সাধারণ নির্বাচনের দু’বছর বাকি। তার চেয়েও বড় কথা, ঢাকায় পুরভোটের সময় এসে গিয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে সেই ভোট আপাতত পিছিয়ে দিচ্ছে সরকার। বিরোধীরা এর মধ্যেই প্রবল ভাবে ময়দানে নেমে পড়েছে। তাদের দাবি, তদারকি সরকারের অধীনে ভোট করতে হবে। না হলে তারা সংসদীয় ভোট বয়কট করবে। পুরভোটও বয়কট করতে পারে।
হাসিনার বক্তব্য, নির্বাচন কমিশন যেখানে ভাল কাজ করছে, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন কী? কমিশনের অধীনে দেশে বিভিন্ন জায়গায় যে নির্বাচন বা উপনির্বাচন হচ্ছে, তাতে বিরোধী খালেদা জিয়ার দলও জিতছে। খালেদা অবশ্য তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে অনড়। এই অবস্থায় তিস্তা চুক্তি না হলে হাসিনা সরকার আরও বিপণ্ণ হয়ে পড়বে বলে মনে করছে আওয়ামি লিগ। আর তা হলে ভারতের ভূ-কৌশলগত সমস্যাও বহু গুণ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশের অন্দরের পরিস্থিতি এখন কেমন? সেখানে সরকার বিরোধী হাওয়াকে কাজে লাগাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মৌলবাদী শক্তি। হাসিনাকে সরাতে সামরিক বাহিনীর একটি অংশও সক্রিয়। রাজনৈতিক ভাবে প্রবল চাপ তৈরি করেছে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি। বিএনপি বলছে, তিস্তা চুক্তি করতে না পারা তো বিদেশনীতির ব্যর্থতা। দেশে মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারি কেন সামলাতে পারছে না সরকার?
এই অবস্থায় হাসিনার দল আওয়ামি লিগ কী করবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লির একাংশের বক্তব্য, তিস্তা চুক্তি হলে হাসিনা সরকার সেটা তুলে ধরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সামলানোর চেষ্টা করত। এখন তিস্তা চুক্তি না হলে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতে যদি আওয়ামি লিগই ভারত-বিরোধিতার তাস খেলতে শুরু করে, তা হলে সেটা দিল্লির পক্ষে অত্যন্ত আশঙ্কার। প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জমানার শেষ দিকে নড়বড়ে অবস্থায় জামাতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন হাসিনা। দিল্লির আশঙ্কা, এ বারও কি তিনি তেমনই কিছু করতে চলেছেন? তা হলে সেটাও ভারতের দিক থেকে গভীর উদ্বেগের বিষয় হবে। ভারতের আশঙ্কা বাড়িয়ে জামাতে ইসলামির প্রতি বার্তা দিয়ে আওয়ামি লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, “যুদ্ধ-অপরাধীদের বাদ দিয়ে জামাত মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করুক। আমাদের বিচার জামাতে ইসলামির বিরুদ্ধে নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “যাদের বয়স ৪০ বছরের নীচে বা ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ১০ বছরের কম ছিল, তারা কেন যুদ্ধাপরাধীদের দায় কাঁধে নিতে যাবে?”
মমতাকে এই পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করবেন মাথাই। তাঁর বক্তব্য, এই অঞ্চলের ভূ-কৌশলগত সমস্যাটা বুঝতে হবে। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা ছাপিয়ে রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা পালন করতে হবে মমতাকে। কারণ, ভারতের ক্ষেত্রে সামরিক ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে সুস্থির সরকার প্রয়োজন।
অন্য দিকে মমতার বক্তব্য, তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে বিকল্প যে দিকগুলির কথা ভাবা হচ্ছে, তাতে বলা হয়েছে, গজলডোবা থেকে দোমোহনি আসার পরে নদীতে জল রিচার্জ হবে। সেই রিচার্জের জল আসবে বৃষ্টি থেকেও। কিন্তু যেখানে জলই কোথাও নেই, বৃষ্টি অনিয়মিত, সেখানে রিচার্জ হবে কী ভাবে? মনে করা হচ্ছে, এই যুক্তি দেখিয়ে কাল তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করবেন মমতা।
এই বিরোধিতার অন্য কারণ রয়েছে বলে জানাচ্ছে তৃণমূল সূত্র। সেই সূত্রে বলা হচ্ছে, কলকাতা সফরের সময় বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি মমতাকে বলেছিলেন, তিস্তার জল দিতে পশ্চিমবঙ্গ বাধ্য। কারণ, সেই জলে বাংলাদেশেরও অধিকার আছে। এর পরে মমতা আরও বেঁকে বসেন। তাঁর এখন বক্তব্য, বাংলাদেশ তো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার মতো কথা বলছে। তা হলে তারা তা-ই করুক।
আবার বাংলাদেশ জানে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে গেলে গোটা বিষয়টির মীমাংসা হতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। দেশের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে সেই সময় দেওয়া হাসিনার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি বা বাংলাদেশ কখনও এমন কথাও বলেনি। এবং সে কারণেই দীপু মণির এই কথায় হাসিনার সচিবালয়ের একাংশ অস্বস্তিতে। ঢাকা চাইছিল, এর মধ্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় সে দেশে এসে আশার কথা শুনিয়ে যান। কিন্তু মাথাই-মমতা বৈঠকের আগে সেই সফর করে লাভ নেই। আর বৈঠক যদি জলে যায়, তা হলে তো কথাই নেই। প্রণববাবুর যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে যাবে। সব থেকে বড় কথা, ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়বে তিস্তা চুক্তি।






Shares