Main Menu

আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন বোকো হারামের ইতিহাস

+100%-

বোকো হারাম প্রথমবারের মত পশ্চিমা নাগরিকদের নজরে আসে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের মঞ্চে সেটাই তাদের প্রথম আবির্ভাব নয়। বিগত দশকে নাইজেরিয়াতে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে এই ভয়ংকর শক্তিশালী জঙ্গীদলটি এবং অনেক আগে থেকেই দেশটির সামাজিক অগ্রগতির সাথে সাথে সমাজের গভীরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার করেছে সন্ত্রাসবাদের শিকড়। বোকো হারামের উত্থান কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা নয় বরং একটি বিপজ্জনক শক্তির উত্থান, উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর আন্দোলন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে নাইজেরিয়ার অস্ত্বিত্ত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ দীর্ঘদিন ধরেই উঁকি দিচ্ছিল।

বোকো হারামের সন্ত্রাসবাদের শুরু হয় ১৯২৭ সালে নাইজেরিয়াতে জন্ম নেয়া উগ্রপন্থী ধর্ম প্রচারক মোহম্মদ মারওয়া মাইতাতসিনের চিন্তার সূত্র ধরে। মাইতাতসিনে আঠারো বছর বয়সে বর্তমানে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কানো শহরে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখান থেকেই সে একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক হিসেবে তার জীবন শুরু করে। তার ধর্মীয় বয়ান ছিল ভয়ানক উগ্র এবং কখনো কখনো উদ্ভট। মোহম্মদ মারওয়া অল্প বয়স থেকেই পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং নাইজেরিয়াতে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে থাকে যে সে ‘মাইতাতসিন’ হিসেবে পরিচিত পায়। মাইতাতসিন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “যে ব্যক্তি নরকে অনন্ত শাস্তির অভিশাপ দেয়।” সে ঘোষণা দেয় কোরআন ব্যতীত অন্য যেকোন বই পড়া হারাম এবং গুনাহর কাজ এবং এটা পৌত্তলিকতার নিদর্শন। সেই সাথে মোহম্মদ মারওয়া হাদিস এবং সুন্নাহ পড়াকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঠিক যেমন খ্রিস্ট ধর্মের ক্যাথলিক অংশের প্রচারকেরা চার্চের নিয়মিত সদস্যদেরকে সেইন্ট অগাস্টিনের লেখা পড়তে নিষেধ করত, কারণ অগাস্টিনের কথা বাইবেলে নেই। তার জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে বিপজ্জনকভাবে প্রায় ঘোষণা দিয়েই ফেলেছিল যে মহম্মদ নয় সে নিজেই আল্লাহর প্রকৃত রাসুল।

A screengrab taken on July 13, 2014 from a video released by the Nigerian Islamist extremist group Boko Haram and obtained by AFP shows the leader of the Nigerian Islamist extremist group Boko Haram, Abubakar Shekau (C). The head of Nigeria’s Boko Haram Islamists, Abubakar Shekau, has voiced support for the extremist Sunni Islamic State (IS) militant group, which has taken over large swathes of Iraq and Syria, in a new video seen on July 13. AFP PHOTO / BOKO HARAM
RESTRICTED TO EDITORIAL USE – MANDATORY CREDIT “AFP PHOTO / BOKO HARAM” – NO MARKETING NO ADVERTISING CAMPAIGNS – DISTRIBUTED AS A SERVICE TO CLIENTS

প্রথম প্রথম নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক নেতারা মোহম্মদ মারওয়া মাইতাতসিনকে তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু যেহেতু ১৯৭০ এর দশকে তার সরকার বিরোধী ধর্মীয় বয়ান দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল সেহেতু সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। মোহম্মদ মারওয়া মাইতাতসিনকে দমন করতে গেলে দেশে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৯৮০ সালে বিদ্রোহ দাবানলের মত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং তার সমর্থকেরা কানোতে সরকারের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়। কানো শহর কার্যত দেশের মূল-ভূখণ্ডের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেটাকে নাইজেরিয়ান বিদুষী লেখিকা এবং ইতিহাসবিদ এলিজাবেথ আলো ইসিচেই প্রায় গৃহযুদ্ধ বলে বর্ণনা করেন। দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯৮২ জন এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনীর অভিযানে ৪০০০ এর বেশি নাইজেরিয়ান নাগরিক নিহত হয় এবং সমর্থকদের সাথে মাইতাতসিন নিজেও এই অভিযানে নিহত হয়।
মাইতাতসিন নিহত হলেও তার উগ্র ধর্মীয় বয়ানের ফলে সৃষ্ট আন্দোলনের আগুন কিন্তু নির্বাপিত হয় না। তার সমর্থকেরা নাইজেরিয়ার বুলুমকুতু অঞ্চলে ১৯৮২ সালে আবারো সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয় এবং সেখানে ৩৩০০ মানুষ নিহত হয়। দুই বছর পরে মাইতাতসিনের সমর্থকেরা নাইজেরিয়ার গঙ্গোলা প্রদেশে ফের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়। সেই দাঙ্গাতেও প্রায় ১০০০ মানুষ নিহত হয়। এক বছর পরে বাউচি প্রদেশেও একইভাবে দাঙ্গাতে শত শত মানুষ নিহত হয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই নাইজেরিয়া জাতিগত এবং ধর্মীয় সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংঘাত বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নাইজেরিয়ার সম্পদ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ফেলছে। নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত জনসাধারণ সাধারণত হাউজা এবং ফালুনি সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার দক্ষিনাঞ্চল খ্রিস্টান অধ্যুষিত আর তারা সাধারণত ইগবো এবং ইয়োরুবা সম্প্রদায়ভুক্ত। ফলে দেশটি মুসলিম এবং খ্রিস্টান প্রধান অঞ্চল নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী আর তাদের নিজস্ব ভাষাগত বিভাজন নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার আগুনে ঘি যোগান দেয়। কিন্তু নাইজেরিয়ার ইতিহাসে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদের কারণে দাঙ্গার চরিত্র খুব বেশি দিনের নয়। মাইতাতসিনের আন্দোলন হলো দেশটির ধর্মভিত্তিক প্রগতিশীলতা পরিবর্তনের আভাস এবং ১৯৭০ দশকে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হওয়া ইসলামিক মৌলবাদের উত্থানের নতুন আঁতুড়ঘর উন্মোচিত হয় নাইজেরিয়াতে।

উনিশ শতক এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের আইন ছিল শরিয়া। বিচারকদের বলা হতো কাদি বা কাজি যারা ইসলামের শরিয়া আইন বিষয়ে পণ্ডিত এবং তারা বিচার কার্যে ইসলাম ধর্মের আইন ব্যবহার করত। ১৯৬০ সালে নাইজেরিয়া যখন যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন স্বাধীনতার বন্দোবস্ত হিসেবে পুরোপুরি শরিয়া আইন পরিহার করার কথা বলা হয়। ১৯৬০ সালের স্বাধীনতা বন্দোবস্ত অনুযায়ী নাইজেরিয়ার মুসলিম সমাজ কিছু শর্ত এবং ক্ষেত্রে শরিয়া আইন প্রয়োগ করার অধিকার নিয়ে তাদের প্রথম সংবিধানের খসড়া লেখা শুরু করে। সেখানে বলা হয় নাইজেরিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলে শরিয়া শুধু ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আইন হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে। নাইজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের বেশির নেতাই বিশ্বাস করতেন দেশটিকে আধুনিকতায় উত্তরণ করতে হলে শরিয়া আইন বাদ দেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই।

কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে মুসলিমদের মনোভাব আবার শরিয়ার দিকে ঝুঁকতে থাকে এবং একই সময়ে মাইতাতসিনের আন্দোলন সমর্থন পেতে শুরু করে। ফিলিপ ওসটিন এবং সাটি ফটসাক তাদের বইতে লিখিছিলেন, “১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি মুসলিমদের এই ধারণার জন্ম নেয় যে, ১৯৬০ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বন্দোবস্তের শর্তে রাজি হওয়া ছিল তাদের জন্য অমার্জনীয় ভুল এবং নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং বিরোধী মনোভাব ক্রমাগত চাঙ্গা হতে থাকে।”

১৯৯৯ সালে ১৯৬০ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের শর্ত বিরোধী মনোভাব এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে নাইজেরিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলে সরকার শরিয়া আইন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়।স্বাধীনতার পর থেকে চলতে থাকা সেনাবাহিনীর একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সুসংহত দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নাইজেরিয়া চতুর্থবারের মত প্রচেষ্টা করে সর্ব সম্মতিক্রমে একটা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার। ১৯৯৯ সালে গৃহীত সংবিধানের ফলে দেশে শরিয়া আইন কার্যকর করার পথ সুগম হয়। শরিয়া আইন বলবত করতে নাইজেরিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তিশালী হয় এবং শরিয়া বিচার আদালতের আপীল যাতে নাইজেরিয়ার আপীল বিভাগ শোনে সেই ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে শরিয়া আইন প্রয়োগ শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে নাইজেরিয়ার বারোটা প্রদেশের মধ্যে নয়টাতে পুরোপুরি শরিয়া আইন কার্যকর আছে এবং বাকি তিনটাতে সিভিল ল হিসেবে শরিয়া আইন মান্য করা হচ্ছে। তবে এই তিন প্রদেশে ক্রিমিনাল এবং সম্পত্তির নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে শরিয়া আইন মান্য করা হয় না।

শরিয়া আইনের সমর্থন বৃদ্ধিতে এবং ১৯৬০ সালের স্বাধীনতার আন্দোলন এবং ঘোষণাপত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট উদারমনা মুক্তবুদ্ধি চর্চার আশায় গুড়ে বালি দেখা দেয় সুতরাং অসাম্প্রদায়িকতা চিরতরে বিদায় নিলো। নাইজেরিয়া সব সময়েই দুর্বল শাসন আর জাতিগত বিদ্বেষে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে শরিয়া আইন কার্যকর হওয়ার পরে উত্তর আর দক্ষিণকে সম্পূর্ণ আলাদা দেশ বলে মনে হয়। এই লেখা থেকেই দেখতে পাবো, নাইজেরিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মের প্রতি ক্রমবর্ধমান প্রবল আসক্তির কারণে দেশটির উত্তরাঞ্চলে মাইতাতসিনের মত উগ্রপন্থী ধর্ম প্রবক্তার উত্থান ঘটে এবং জন্ম নেয় বোকো হারাম।

বোকো হারামের আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০০২ সালে নাইজেরিয়ার বরনো প্রদেশের ইসলামের কট্টোরপন্থী ধর্মগুরু মোহাম্মদ ইউসুফ এবং একদল ইসলাম ধর্ম প্রচারকের হাত ধরে। মোহাম্মদ ইউসুফ তার সমর্থকদের মাঝে কোরআনের উগ্র ব্যাখ্যা প্রচার করত এবং সে মনে করত ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন নাইজেরিয়া গঠন করা হলেও নাইজেরিয়ার মুসলিমদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সেখানে মুসলিমরা অনৈসলামিক জীবন যাপন করছে। মোহাম্মদ ইউসুফ ছিল একনিষ্ঠ ধার্মিক এবং ইসলামী মৌলবাদী। তার ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা গভীরভাবে ওয়াহাবি ধর্মতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। মোহাম্মদ ইউসুফ দেশব্যাপী এমনকি খ্রিস্টান অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলেও শরিয়া আইন কার্যকর করার মাধ্যমে নাইজেরিয়াকে সত্যিকারের ইসলামী দেশে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে। বোকো হারামের অর্থায়নে মোহাম্মদ ইউসুফ নাইজেরিয়ার মাইদুগুরি প্রদেশে মাদ্রাসা এবং মসজিদ নির্মাণ করে। সমস্ত নাইজেরিয়ার এমনকি প্রতিবেশী দেশের দরিদ্র মুসলিম পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে। বোকো হারাম সেখানে সে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই দিতো না বরং বোকো হারামের উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রাসার শিশুদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে পরিপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই বোকো হারামের মাদ্রাসা জিহাদি সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

বেশিরভাগ মানুষের প্রশ্ন, “বোকা হারাম কারা? এবং কীভাবেইবা নাইজেরিয়ার সন্ত্রাসী মঞ্চে তাদের আবির্ভাব হলো?”
নাইজেরিয়ার সবচেয়ে প্রচলিত আদিবাসী ভাষা হাউজা থেকে বোকো হারাম নামটি এসেছে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থা নিষিদ্ধ’। বোকো শব্দের আভিধানিক অর্থ মিথ্যা কিন্তু এখানে বোকো শব্দ দিয়ে পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বোঝানো হচ্ছে। অপরদিকে হারাম অর্থ নিষিদ্ধ। বোকো হারাম দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রভাবিত সংস্কৃতিকে গুনাহ বা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ধর্মদ্রোহিতা হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। বোকো হারামের প্রকৃত নাম হলো জামা’তু আহলিস সুন্না লিদ্দা’ওয়াতি ওয়াল-জিহাদ। আরবি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করলে সংগঠনটির অর্থ দাঁড়াবে “নবী মহম্মদের শিক্ষা এবং জিহাদ ছড়িয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ”।

শুরুর দিকে বোকো হারাম মৌলবাদী হলেও এত ধ্বংসাত্মক ছিল না। তারা ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে ২০০৯ সালে যখন বোকো হারামের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা শরিয়া ব্যতীত অন্য কোন আইন মানবে না। নাইজেরিয়ার আইনে মোটর সাইকেল আরোহীকে মাথায় হেলমেট প্রতে হয়। কিন্তু বোকো হারামের সদস্যরা মাথায় হেলমেট পরাকে অনৈসলামিক মনে করে এবং আইন মান্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। আইন অমান্য করার অভিযোগে কয়েকজন বোকো হারাম সদস্যকে আটক করে নাইজেরিয়ার পুলিশ। বোকো হারাম সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে এবং নাইজেরিয়ার পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষে ৮০০ মানুষ নিহত হয়। বোকো হারামকে দমন করার জন্য সরকার ‘অপারেশন ফ্লাশ ২’ নামে একটা টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্স মাইদুগুরিতে ইউসুফের সমর্থকদের মুখোমুখি অবস্থান নেয় ২০০৯ সালে এবং সংঘর্ষে ১৭ জন বোকো হারাম সদস্য নিহত হয়। ইউসুফ নিরাপত্তাবাহিনীকে আল্লাহর গজব নাজিল হওয়ার অভিশাপ দিয়ে তার সমর্থকদেরকে পালটা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে আদেশ দেয়।

২০০৯ সালের দাঙ্গার পরে বোকো হারাম ভীষণরকম হিংস্র হয়ে ওঠে। বোকো হারামের নতুন নেতা আবুবাকার শেকাও ছিল প্রচণ্ড মৌলবাদী এবং সে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করে এবং বোকো হারামের মৌলবাদী চিন্তাভাবনা আল-কায়েদার মত আন্তর্জাতিক জিহাদি দলের সাথে সংযুক্ত করে এবং যোগাযোগ স্থাপন করে। তাদের বিচার বিবেচনাহীন জঙ্গী আক্রমণের একটা উদাহরণ হতে পারে এরকম, নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের যেসব স্থানে বোকো হারাম শক্তিশালী সেখানে মোটরগাড়ির ড্রাইভারদের আতংকিত করার জন্য যন্ত্রচালিত করাত দিয়ে ট্রাক ড্রাইভারদেরকে জবাই করতে শুর করে আইসিস স্টাইলে। নাইজেরিয়ার অর্থনীতিতে ধ্বস নামানোর উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই বোকো হারাম পরিকল্পিতভাবে ট্রাক ড্রাইভারদের হত্যা করে যাতে তারা ট্রাক চালিয়ে মালামাল আনা নেয়া করতে না পারে।

ঘটনার পর পরই নাইজেরিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মোহাম্মদ ইউসুফকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে নিরাপত্তাবাহিনী তাকে বিদ্রুপ করে বলে, যে পশ্চিমা শিক্ষা, বিজ্ঞানের বিষোদ্গার করেন, সেই পশ্চিমাদের আবিষ্কৃত কম্পিউটার কেন ব্যবহার করেন? জিজ্ঞাসাবাদের পরে কোন বিচার ছাড়াই হত্যা করে এবং সরকার এটাকে ‘বন্দুক যুদ্ধ’ বলে প্রচার করে। পাঁচ দিনব্যাপী সংঘর্ষে বোকো হারাম পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে এবং সেনাবাহিনী প্রতিরোধে নামার আগ পর্যন্ত পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধ চালিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর কাছে ইউসুফ ধরা পড়ে এবং সেনাবাহিনী তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ দাবী করে ইউসুফ পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তার মৃতদেহ দেখানো হয় এবং নিরাপত্তাবাহিনী ঘোষণা দেয় বোকো হারাম অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি। কিছুদিন পরে একটা ভিডিও প্রকাশিত হয় যেখানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে বোকো হারাম সদস্য সন্দেহে মানুষদের মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়তে বলা হয় এবং এরপর সেনাবাহিনী তাদের উপর গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে প্রায় ৮০০ মানুষ নিহত হয়। ২০০৯ সালে ইউসুফের মৃত্যুর পর তার সহযোগী আবুবাকার শেকাও গোপনস্থানের অজ্ঞাতবাস থেকে ভিডিও প্রকাশ করে নিজেকে বোকো হারামের নতুন নেতা হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং শক্তি সঞ্চয় করে ২০১০ সালে বোকো হারামকে পুনরায় সংগঠিত করে। তখন তারা আততায়ী হিসেবে অতর্কিত হামলা শুরু করে এবং জেলখানায় হামলা করে। বোকো হারাম ক্রমেই আধুনিক বিস্ফোরক এবং অস্ত্র নিয়ে মরণঘাতী আক্রমণ শুরু করে। ২০১১ সালে আগস্টে বোকো হারামের একজন আত্মঘাতী সদস্য নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজায় গাড়ি ভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। সেখানে ২৩ জনের মৃত্যু হয় যাদের বেশিরভাগই দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নাইজেরিয়ার উত্তর এবং মধ্যাঞ্চলে এরকম জঙ্গী হামলার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটতে থাকে। বোকো হারামের আক্রমণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মোটরবাইকে করে একজন বন্দুকধারী অতর্কিতে এসে গুলি করে চলে যায়। ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এরকম হামলা নিয়মিত ঘটনা। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বিস্তৃত এবং সপ্তাহে কয়েকবার চলতে লাগল। বোকো হারাম রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা, নিরাপত্তাকর্মী এবং বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে হামলা চালাতে লাগল।

জঙ্গী হামলা পরিচালনার এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে বোকো হারাম ব্যাংক ডাকাতি শুরু করে। অর্থের উৎস বের করতে তারা নাইজেরিয়ার উপকূলে যাতায়াত করা জাহাজে দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে ছিনিয়ে নিতে লাগল টাকা-পয়সা আর সেই সাথে চলতে লাগল মাদক চোরাচালানের কারবার। গত বছর বোকো হারাম পূর্ণাঙ্গ পদাতিক বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাংক কিনতে সক্ষম হয়। এবার তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে, পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাতে। বোকো হারাম জঙ্গী দলের আগমন ঘটলেই অনেক সময় নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী, পুলিশ নিরাপত্তা, তল্লাশি চৌকি ফেলে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যেত। বোকো হারামের আক্রমণও করা লাগত না। নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি যখন ঘোষণা দেন বোকো হারাম সদস্যরা যদি অস্ত্র ত্যাগ করে তবে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা করে দেয়া হবে তখন বোকো হারামের নেতা রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে উলটো সরকারকেই বোকো হারামের কাছে আত্মসমর্পণ করার হুমকি দেয়। এমনকি বোকো হারাম সরকারকেও ক্ষমা করার হাস্যকর প্রস্তাব দেয়।

যেহেতু বোকো হারাম ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে সেহেতু এটা পরিষ্কার যে নাইজেরিয়ান সরকার বোকা হারামের বিদ্রোহ আর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারবে না। পশ্চিমা গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এসব খবর প্রকাশ পায় এবং পাঠকের মনে এমন নির্বিকার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যেন জঙ্গী হামলায় মৃতের ঘটনা ভূমিকম্প বা যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতই স্বাভাবিক। কিন্তু বোকো হারাম নিয়মিত জঙ্গী হামলা চালিয়েই যাচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনীর নাকের ডগায়। বোকো হারামের প্রত্যক্ষ তৎপরতার কারণেই দেশটিতে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। আজকের এই বিষবৃক্ষের বীজ প্রোথিত হয়েছিল কয়েক দশক আগে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বোকো হারাম প্রায় ৩০০ স্কুল বালিকাকে অপহরণ করেছে। বিগত বছরগুলোতে মধ্যেবোকো হারাম আল-কায়েদার কাছ থেকে হাতে কলমে শিখে নেয় সন্ত্রাসী হামলায় কীভাবে বিস্ফোরক ব্যবহার করে একসাথে অনেক মানুষকে হত্যা করা যায়। আল-কায়েদার সাথে বোকো হারামের ক্রমবর্ধমান যোগাযোগের কারণে নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকা অঞ্চলে আতংক ছড়িয়ে পড়ে এই চিন্তায় যে বোকো হারাম হয়ত নাইজেরিয়ার বাইরে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে দেবে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে তারা ইরাক এবং সিরিয়ার আইসিসের সাথে যোগসুত্র স্থাপন করেছে। প্রথমে আল-কায়েদা এবং পরে আইসিসের মত জিহাদি সংগঠনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরে বোকো হারাম নিজেই আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে যেমন নাইজেরিয়ার বাইরে চাদ, নাইজার এবং ক্যামেরুনের উত্তরাঞ্চলে বোকো হারামের কার্যক্রম বিদ্যমান আছে।

মূল প্রবন্ধ: The History Of Boko Haram. Here’s All You Need To Know এবং The Origins of Boko Haram
লেখকঃ জন ফোর্ড এবং টেমি ব্যাঞ্জো






Shares