Main Menu

সৌদি , কুয়েতে , মালয়েশিয়ার ও শ্রমবাজার দরজা খুলছে না নতুন বাজার নেই ও ভরসা কেবল আমিরাত

+100%-
বর্তমান বছরের প্রথম তিনমাসে সৌদি আরবে মাসে গড়ে এক হাজার বাংলাদেশি সেখানকার শ্রম বাজারে গেছেন। অথচ তিন বছর আগে মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো দেশটিতে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরবে এখন শ্রমিকরা যাবার বদলে দেশে ফিরছেন বেশি। ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ লোক দেশটিতে গেছেন। কিন্তু গত তিন বছরে সেখানে গেছেন মাত্র ৩৪ হাজার বাংলাদেশি; আর একই সময়ে ফিরেছেন ৫০ হাজারের বেশি। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সরকার গত তিন বছরে নতুন কোন শ্রমবাজার তেমন একটা না পেলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি বেশ বেড়েছে। ক্রমশ বাংলাদেশের শ্রমবাজার হয়ে উঠছে আরব আমিরাত কেন্দ্রিক। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনশক্তি রপ্তানি খাতে গত তিন বছর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লেও এ বছরের প্রথম তিনটি মাস ভালই গেছে। প্রথম তিন মাসে দেড় লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জনশক্তির রপ্তানি পরিস্থিতি এখন বেশ ভাল। ২০০৯ ও ২০১০ সালের চেয়ে জনশক্তি রপ্তানি একটু কমে গেলেও গত বছর থেকে তা বাড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, বিদেশে বন্ধ বাজারগুলো চালু করতে সব ধরনের চেষ্টাই চলছে। মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বৈধকরণ চলছে। সেটি শেষ হলে আবার শ্রমবাজার চালু হতে পারে।

মন্ত্রী বলেন, শ্রম বাজার শক্তিশালী করতে সরকার কূটনৈতিক উদ্যোগও দ্রুত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের শ্রম কাউন্সিলারদের ঢাকায় ডেকে এনে বৈঠক করে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় সংকট কাটেনি :বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশের সংকট কাটেনি। দুই বছর ধরে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ। একই অবস্থা কুয়েতেও। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিও এখন বাংলাদেশ থেকে লোক নিচ্ছে না। অথচ আগে প্রতিবছর ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার বাংলাদেশি সেখানে যেতেন।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই তিন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সব ধরনের উদ্যোগই নেয়া হয়েছে। তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দাবি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই তিনটি শ্রমবাজার ধরে রাখতে সরকারের চেষ্টার পরও কোনো সফলতা আসেনি। শুধু সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও কুয়েতই নয়; লিবিয়ায়ও লোক পাঠানো বন্ধ। ইরাকে অনেক সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও বাস্তবতা উল্টো।

আর নতুন শ্রমবাজার খোঁজার চেষ্টায়ও সফলতা নেই। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকার পাঁচটি কমিটি করে। কমিটি নতুন বাজারের খোঁজে বিভিন্ন দেশ সফরও করে, কিন্তু নতুন কোনো শ্রমবাজার খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতকে কেন্দ্র করেই টিকে আছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে গত জানুয়ারি মাসে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে পাঠায়। কমিটি গত ১০ বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির পরিসংখ্যান, সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চায়। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয় সংসদীয় কমিটির কাছে।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ প্রতিনিধিকে  বলেন, সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়া ছিল বাংলাদেশের মূল বাজার। কিন্তু এই বাজারগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি কেন কমে গেছে, তা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিটি এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে। এখন একটি সুপারিশমালা তৈরি করে মন্ত্রণালয়কে দেয়া হবে। তবে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ভালোর দিকে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে আট লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন এবং ২০০৮ সালে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে যান চার লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। ২০১০ সালে এ সংখ্যা আরেক দফা কমে দাঁড়ায় তিন লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জনে। তবে ২০১১ সালে তা বেড়ে সাড়ে চার লাখ ছাড়ায়

আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৌদি আরবে : সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে এক লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন কর্মী, ২০০৭ সালে দুই লাখ চার হাজার ১১২ এবং ২০০৬ সালে এক লাখ নয় হাজার ৫১৩ জন কর্মী সৌদি আরবে গেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালে মাত্র ১৪ হাজার এবং গত বছর মাত্র সাত হাজার কর্মী সেখানে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম তিনমাসে মাত্র ৩ হাজার কর্মী সৌদি আরব গেছেন।

এখন সৌদি আরব বেশি লোক নিচ্ছে নেপাল ও ভারত থেকে। শুধু জনশক্তি রপ্তানি কমানো নয়, সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতিপত্রও (আকামা) বদল করতে দিচ্ছে না। তাই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে ছয় থেকে সাত লাখ কর্মীকে।

এ সম্পর্কে মন্ত্রণালয় থেকে সংসদীয় কমিটিতে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে বেশিরভাগ সরকারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সৌদিকরণ কর্মসূচি এবং ভিসার ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা চালুর কারণে সেখানে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ কর্মী কর্মরত থাকায় বাংলাদেশ কোটার সমস্যায় পড়েছে। এর বাইরে দক্ষ জনশক্তির বিপরীতে অদক্ষ জনশক্তি পাঠানো এবং কারিগরি জ্ঞানহীন স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের পাঠানোর কারণেও সৌদি আরবের শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

মালয়েশিয়ার দরজা খুলছে না : এ দেশে ২০০৯ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ। ২০০৮ সালে এক লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন, ২০০৭ সালে দুই লাখ ৭৩ হাজার ২০১ এবং ২০০৬ সালে ২০ হাজার ৪৬৯ জন বাংলাদেশি কাজ করতে যায় সেখানে।

জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের কারণ সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়ার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে গত বছরের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালয়েশিয়া সফরের সময় এ ব্যাপারে ওই দেশের সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনার প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ায় বর্তমানে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

কুয়েতেও একই অবস্থা : ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ২৫ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। ২০০৯ সালে এসে তা একরকম বন্ধই হয়ে যায়। ২০০৯ সালে মাত্র ১০ জন লোক কুয়েতে গেছেন। ২০১০ সালে গেছেন ৪৮ জন।

কুয়েতের জনশক্তি সমস্যা সমাধানে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েত সফর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কুয়েতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার অনুরোধ জানান। তবে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, কুয়েতে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। কিন্তু সেখানকার শ্রমবাজারে বর্তমানে প্রভাব বিস্তারকারী মিসর, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিরা টিকতে পারছেন না। বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বড় সমস্যা ভাষা না জানা। কুয়েতে বেশির ভাগ সরকারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ‘কুয়েতাইজেশন’ কর্মসূচিও একটি বড় সমস্যা।

ভরসা আরব আমিরাত :তিন বছর ধরে বাংলাদেশের শ্রমবাজার একেবারেই আরব আমিরাত  কেন্দ্রিক। ২০০৮ সালে চার লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমে হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৮ এবং ২০১০ সালে দুই লাখ তিন হাজার ৩০৮ জন কর্মী সেখানে কাজ নিয়ে গেছেন। ২০১১ সালে  দুই লাখ লোকের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে।  ২০১২ সালের প্রথম তিন মাসে ৭০ হাজারের বেশি কর্মী দেশটিতে গেছে। যা একটি রেকর্ড।

লিবিয়ার বাজারও বন্ধ :বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার যখন বন্ধ ছিল, তখন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের আশার আলো ছিল লিবিয়া। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে এই দেশটিতেও লোক পাঠানো বন্ধ। এ বছরের মার্চে যুদ্ধাবস্থা শুরুর পর দেশটি থেকে প্রায় ৪০ হাজার লোককে ফিরে আসতে হয়।

নতুন বাজার নেই :বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত সোয়া তিন বছরে বারবার নতুন বাজারের কথা বলা হচ্ছে। প্রচলিত শ্রমবাজারের বাইরে গত বছর নতুন ১৬টি দেশের তালিকা করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হলো: জাপান, হংকং, তাইওয়ান, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা ও জিম্বাবুয়ে। এই দেশগুলোর পরিস্থিতি দেখতে প্রবাসী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচটি দলও গঠন করা হয়। এ পরিকল্পনা নিয়ে  অনেক দেশ সফর হলেও নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া যায়নি।






Shares