Main Menu

সিঙ্গাপুর কাজ করতে আসবেন? তাখলে আমার জীবনের গল্পটা একটু পড়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিন, আসবেন কি না।

+100%-

image_6954সিঙ্গাপুর পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলির একটি, জীবন মান নিরাপত্তা সব কিছুর বিশ্লেষনের পরে সর্বোচ্চ আসনটা এরা দখল করে রাখে।
আমরা প্রায় এক লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক সিঙ্গাপুরে কাজ করি, সাধারনত দুইটা সেক্টরই আমাদের ৯৯.৯৯ ভাগ শ্রমিক কাজ করে।
১) নির্মান সেক্টর
২) সিপ বিল্ডিং

আমি মূলত নির্মান সেক্টরে একজন সাধারন শ্রমিক হিসাবে সিঙ্গাপুরে এসেছি, এখনও সেই সাধারন শ্রমিক হিসাবেই আছি। তবুও সেই প্রথমকার দিন গুলি খুব যন্ত্রনাদায়ক ছিল যা কল্পনাকেও হার মানিয়ে দিত।
বর্তমানে যারা সিঙ্গাপুরে বেড়াতে আসেন সবার কাছেই পছন্দের শীর্ষে থাকে “মেরিনা বে সেন্ডস” ব্যয়বহুল আর বিলাসিতার দিক থেকে এই শহর পৃথিবীর সব শহরকে পিছনে ফেলে শীর্ষে অবস্থান করছে কয়েক বছর যাবত।
আমার কর্মজীবনের প্রথম কাজ শুরু করি এই “মেরিনা বে সেন্ডস” এর কাজ দিয়ে, দৈনিক ১৮ ডলার বেসিক সাথে ৩ ডলার ঘন্টা ওভার টাইম, এই প্রাথমিক হিসাবেই আমার কাজ শুরু।

আমার প্রথম কোম্পানির নাম “হং ডাট ইন্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড” এরা মুলত বিভিন্ন দেশ থেকে ওয়ার্কার এনে বড় বড় কোম্পানিতে বেশি দামে সাপ্লাই দিত, আমাকেও ঠিক “এমবিএস – মেরিনা বে সেন্ডস” প্রজেক্টের একটা জার্মানি পাইলিং কোম্পানইতে সাপ্লাই দেওয়া হল। যেহেতু নতুন শ্রমিক কোন কাজেই অভিজ্ঞতা নাই সুতরাং আমাকে ষ্টোর কিপারে সহকারি হিসাবে দেওয়া হল সাথে বসদের অফিস ক্লিন করা থেকে শুরু করে ষ্টুরেজ এরিয়া এবং শ্রমিকদের রেষ্ট এরিয়া পর্যন্ত ক্লিন করতে হত। এখানে অফিস বলতে সীপ কন্টেইনারে বানানো অস্থায়ী অফিস, কিছুদিন পর পর জায়গা পরিবর্তন করতে হত।
আমার খাবর সময় দুপুর ১২টা থেক ১টা পর্যন্ত আর রাতের কাজে আসলে রাত্র ১২ থেক ১ টা পর্যন্ত।

সিঙ্গাপুরে আবহাওয়া বিষয়ে অনেকেরই ধারনা আছে, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টি আমার কাজের চাপ আরো বাড়িয়ে প্রায় ২/৩
গুন করে দিত।
একদিন রাতে খাবার খেতে বসেছি, ৩/৪ মিনিট পরেই বৃষ্টি শুরু একেবারে গ্রাম্য ভাষায় আকাশ ছিদ্রহয়ে বৃষ্টি। আমি ভাবছি খাবারটা শেষ করে গিয়ে পাম্প গুলি চালু করব, হয়তো ৫/৬ মিনিট সময় লাগবে। যত দ্রুত সম্ভব আমার খাবার শেষ করার চেষ্টা করছি।
ফ্লোরে বসে খাবার খাচ্ছি, আমি শুধু একানা সাথের সাবাই নিচে বসে খাচ্ছি। কাগজের প্যাকেটে খাবার, ৬/৭ ঘন্টা আগের রান্না তারপরও পরিশ্রমী শরীরে এই খাবারটা আমৃতের মত মন হচ্ছে।
কোন কিছু চিন্তা করার আগেই দেখলাম পিছন থেকে একজন লোক এসে লাথি দিয়ে আমার খাবারের প্যাকেট ফেলে দিয়েছে, সাথে গালাগালিতো আছেই।
আমার অপরাধ বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখেও কেন আমি পাম্প চালু করছিনা, অথচ আমাদের ষ্টোরেজ ট্যাং ২/৩ ঘন্টার বৃষ্টির পানি জমা রাখার ব্যবস্থা আছে। যিনি আমার খাবার ফেলে দিয়েছেন উনি এই প্রজেক্টের একজন “সেফটি এন্ড হেল্থ সুপারভাইজার” ঐ সময়ে এই পদের লোক গুলির অনেক ক্ষমতা ছিল এবং সব সময় ক্ষমতার ব্যবহার করতো।

নতুন মানুষ কিছুই বলার ছিলনা, চোখের কোনে কিছু লোনা পানির জমাট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ঐ দিন নিজের জীবনের উপর একটা রাগ এসেছে সাথে পরিবারের মানুষগুলির উপরও একটা ঘৃণার তৈরী হয়েছে। আজ যদি আমার পরিবার সচ্ছল হতো তাখলে নিশ্চয় এমন পরিস্থিতির সম্মুহীন আমাকে পরতে হতোনা।
এইটা কোন একদিনের ঘটনা ছিলনা, প্রায় ১৬ মাসের অনেক বারই এমন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছে। কখনো খাবারের সময় কখনোবা ঘুমের সময় কেও এসে লাথি দিয়ে বসে গালাগালি করছে, বার বার শুধু চোখের কোনে একটু লোনা পানির সন্ধান পেয়েছে এর বেশি কিছুইনা।

এইটাছিল ২০০৭ সালের জুলাই মাসের ঘটনা, এরপর এত গুলি বছরে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে “এমবিএস” এর পাইলিং করেছি সেই প্রজেক্ট আজ সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জায়গা সাথে ট্যুরিষ্টদের প্রধান আকর্ষন। আমিও ফেলে এসেছে পূর্বের কোম্পানি সাথে অনেক চ্যালেন্জিং কাজ, এখন আমি কাজ করি একটা ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে।

গত কয়েকমাস আগে আমাদের একটা সাব কন্ট্রাকটর নিলাম মাঝারি মানের একটা প্রজেক্টের জন্য, ওদের ডকুমেন্ট গুলি যখন আমার হাতে আসলো তখন একটা মানুষের ছবিতেই আমার চোখ আটকিয়ে আছে। সে হল “মি. কেনিরি”
এই সেই লোক যে লাথি মেরে আমার খাবার ফেলে দিয়েছে, অথচ আজ আমি ইচ্ছে করলে উর হাজার হাজার ডলার ক্ষতি করতে পারি এমন কি উর বসকে একটা মেইল করলে এমন কেনরি কেন ওর প্রজেক্ট ম্যানেজারকেও বিনা নোটিশে চাকরি ছাড়া করবে।
অনেক রাগ আর ক্ষুভ নিয়ে সবগুলি কন্ট্রাক্টরের সাথে মিটিংএ বসলাম, আমি যেখেতু প্রজেক্ট কো-অরডিনেটর সেহেতু মিটিং আমাকেই পরিচালনা করতে হচ্ছে। মি. কেনরি অপলক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হয়তো ভাবছে এখন নিশ্চয় বড় কোন দূর্ঘটনা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ২০০৭ সালের অসহায় একটা বাঙ্গালি শ্রমিকের মলিন মুখ, যা দেখে সে বড্ড তামাশা করত।
প্রথমেই ওয়ার্কপ্লেস সেফটি এন্ড হেল্থ নিয়ে কথা শুরু হল, এই কথা সেই কথা সব কথা শেষে আমি কেনিরিকে দাড় করিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম “মি. কেনিরি আমার কাজের জীবনের প্রথম সেফটি সুপারভাইজার, সুতরাং আশা করব আপনারা সবাই উনাকে এমন হিসাবেই দেখবেন”

রাগটাকে ভালবাসায় ফেলে আমি মিটিং রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম, মিটিং রুম থেকে আমার ডেক্সে যাচ্ছি এমন সময় অনুভব করলাম কেও একজন আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল। তাকাতেই মি. কেনিরি, হাসি দিয়ে বল্লাম কিছু বলবে?
সে লজ্জিত চোখে শুধু বল্ল “ঐ সময়ের ঘটনা গুলির জন্য আমি লজ্জিত”

আমি কিছুই বলতে চাইলাম না, তারপরও হাসি দিয়ে বল্লাম ভুলে যাও সেইসব কথা। সুন্দর ভাবে কাজ কর, যাতে তোমাদের নামে কোন প্রকার কমপ্লিন না আসে।

এই ভাবেই শুরু হয়েছিল আমার সিঙ্গাপুর জীবনের প্রথম অধ্যয়টা, কেও যদি নির্লজ্জের মত বেহায়া হয়ে পরে থাকতে পারেন তাখলে আপনি বিদেশে আসতে পারেন। নিশ্চিত করেই বলতে পারি আপনি কোন একদিন সফল হবেন……………..






Shares