Main Menu

প্রেক্ষাপট নাসিরনগর- সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় মুসলমানদের কাজ করতে হবে

+100%-

ehs111

সোহরাব শান্ত  :: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গত রোববারের ঘটনায় আমরা ব্যথিত। পবিত্র কাবা ঘর তথা ইসলাম ধর্মের অবমাননাকে কেন্দ্র করে সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর এবং তাদের বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো বাড়িতে বাসিন্দাদের উপর শারীরিক আক্রমণসহ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ইত্যাদি লুট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একইদিন হিন্দুবাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের মাধবপুরেও। এ ধরণের ঘটনা খুবই দুঃখজনক, বেদনাদায়ক, নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নাসিরনগরের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজন বর্তমানে ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে আছেন। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, হিন্দু পাড়াগুলোর অনেক ঘরেই তালা ঝুলছে। অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো হিন্দু পরিবার সুহৃদ মুসলমান বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তবুও আস্থাহীনতায় আছেন তারা।

ঘটনার সূত্রপাত নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের রসরাজ নামক জনৈক সনাতন ধর্মাবলম্বীর ফেসবুক ওয়ালে ফটোশপের মাধ্যমে সম্পাদনা করে বানানো একটি আপত্তিকর ছবি পোস্ট করা নিয়ে। ফেসবুকে ছবিটা কিছু মানুষের নজরে আসার পরই গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মারধর করে গত শুক্রবার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ ওই রাতেই আইসিটি আইনে মামলা দিয়ে পরদিন রসরাজকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজাতে পাঠায়। ঘটনা জানাজানি হলে উপজেলা সদরে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে থাকে। শনিবার সারাদিন বিক্ষিপ্তভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদ হয়। উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে রোববার সকালে প্রতিবাদ কর্মসূচি দেয় স্থানীয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত। হেফাজতে ইসলামও আলাদা কর্মসূচি দেয়। তবে সরাসরি হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে নয়, ‘খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নামে!

পরদিন রোববার দুপুরের ঘটনা তো গণমাধ্যমের কল্যাণে কমবেশি সবাই আমরা জানি। ‘তৌহিদী জনতা’ নাম দিয়ে একদল মানুষ পুরো নাসিরনগর সদরের হিন্দু পাড়াগুলোয় নজিরবিহীন ভাঙচুর চালায়। হামলা হয় অভিযুক্ত রসরাজের গ্রাম হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে। একইদিন সন্ধ্যায় হামলা হয় পাশ্ববর্তি মাধবপুর উপজেলার (হাবিগঞ্জ জেলা) হিন্দু পাড়াগুলোয়। গণমাধ্যমে খবর এসেছে এ ঘটনার জের ধরে সোমবার সন্ধ্যায় একদল মুসলমান সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার কয়েকটি মন্দিরে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। এটুকু অবলোকন করে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

অবশ্য আশার কথা হচ্ছে, নাসিরনগর উপজেলা সদরে যখন হিন্দুদের উপড় হামলা হয়, তখন তা ঠেকানোর চেষ্টা করে তাদের প্রতিবেশি মুসলমানরা। অনেক মুসলমান পরিবার তাদের পরিচিত-অপরিচিত হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছেন। বিবিসি বাংলা’র মতো গণমাধ্যমের খবরে এ বিষয়টা উপস্থাপন করা হয়েছে। আক্রান্ত হিন্দুরা এ জন্য মুসলমান প্রতিবেশিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

বর্তমানে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, বিশেষত নাসিরনগর উপজেলার হিন্দুরা ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে আছেন। আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে তারা আতঙ্কগ্রস্ত। তাদের কোনো কোনো পরিবার অদূর ভবিষ্যতে ভারত চলে যাওয়ার কথা বিবেচনা করলে ভুল বলা হবে না। ছোট-বড় নানা ইস্যুতে এ দেশের হিন্দুরা বাপ-দাদার ভিটে-মাটির মায়া ত্যাগ করে ভারত চলে যেতে বাধ্য হয়েছে- স্বাধীনতার পর থেকে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।

এদিকে সোমবার বিকেলে নাসিরনগর উপজেলা সদরে একটি ‘শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ’ হয়েছে। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতাসহ স্থানীয় মুসলীম সংগঠনগুলোর (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এবং হেফাজতে ইসলাম) নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, হিন্দুদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে কাজ করবেন।

আমরা মনে করি, সম্প্রীতি সমাবেশে ভাল ভাল কথা বলার চেয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আস্থা ফেরানোটা প্রশাসনের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রুত ভাল কাজ করে দেখানো জরুরী। যেন তারা নিজেদর নিরাপদ ভাবতে পারে। তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া জরুরী। ভবিষ্যতে যেন আর কোনো মহল কোনো ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের উপড় হামলা করতে না পারে, এজন্য বর্তমান ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করাও জরুরী।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নাসিরনগরের ঘটনায় করা পৃথক তিন মামলায় কয়েক হাজার মানুষকে আসামী করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা অতীতের মতো প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে স্থানীয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে ‘আইওয়াশ’ করা হবে না। কয়েক মাস আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে মাদ্রাসা ছাত্রদের তাণ্ডবের ঘটনায় এ ধরণের প্রাশাসনিক উদ্যোগ আমরা দেখেছি। যেখানে প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে স্থানীয় বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে আইওয়াশ করা হয়েছে।

নাসিরনগরের ঘটনার পেছনের কারণ বের করতে এবং প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে কিছু প্রশ্নের উত্তর বের করাও জরুরী- প্রথমত, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অভিযুক্ত রসরাজ একজন জেলে। পিছিয়ে থাকা ওই পেশার একজন মানুষ হঠাৎ কেন এমন একটা কাজ করতে গেলেন? ফটোশপে এত নিখুঁতভাবে এমন নোংরা ও আপত্তিজনক ছবি তৈরির মতো শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতা তার আছে কিনা? যদি না থাকে তাহলে এর পেছনে কে বা কারা? রসরাজের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড অন্য কেউ জেনে তা ব্যবহার করতো কিনা? যারা বড় কোনো স্বার্থ হাসিল বা সামাজিক সম্প্রিতি নষ্টের ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে এ কাজ করেছে? তদন্তে বিষয়টা বের করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। তা রসরাজ নিজে হোক বা পেছনে থাকা মানুষজন যেই হোক। যেন ভবিষ্যতে কেউ ইসলাম ধর্মসহ অন্য কোনো ধর্মের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে অবমাননাকর কোনো কাজ করার সাহস না করে।

দ্বিতীয়ত, ‘খাঁটি’ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত- নামের সংগঠনটির উদ্ভব কখন হলো? কেন হলো? কয়েকটি সূত্র বলছে, হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই ‘খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নাম নিয়ে নাসিরনগরের খেলার মাঠে সমাবেশ করেছে। গণমাধ্যমে আসা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হেফাজতে ইসলামের বক্তব্যও এ তথ্যের সত্যতা জানান দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হেফাজতে ইসলাম কোন উদ্দেশ্যে, ‘খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নাম দিয়ে মাঠে এলো? ‘তৌহিদী জনতা’ নাম দিয়ে কারা হামলা চালালো- এই প্রশ্নের উত্তর বের করাও জরুরী। অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই ব্যানারে প্রতিবাদ এবং আক্রমণাত্মক কাজ হয়েছে।

তৃতীয়ত, স্থানীয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত (যাদের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কোনো যোগ নেই) তাদের প্রতিবাদ সমাবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে অনুসারীদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে? নাসিরনগর কলেজ মোড়ে তাদের প্রতিবাদ সমাবেশ চলার সময় তাদরে অনুসারীরা হামলায় অংশ নিয়েছে কিনা? হামলার ঘটনার পর তাদের ভূমিকা কি? সংগঠনটির নেতারা কি হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন?

চতুর্থত, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী উপজেলা সদরের পূর্বদিক থেকে ট্রাকে করে একদল তরুণ এসেছিল। স্থানীয়রা বলছে হামলাকারীরা বেশিরভাগই ছিল অচেনা মুখ। ট্রাকে করে আসা তরুণরাই কি তাহলে মূল হামলা ভয়াবহভাবে চালালো? ওই তরুণের দল কারা? কোথা থেকে এসেছিল? কে বা কারা তাদের মদতদাতা? নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়ন লাগোয়া হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় হামলার পেছনেও কি ওই গ্রুপটার কোনো যোগসূত্র বা অংশগ্রহণ আছে?

পঞ্চমত, রোববার হামলা হওয়ার আগে থেকেই হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল। শনিবার রাতে মাইকিং করে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উত্তেজিত করা হয়েছে। প্রতিবাদের নামে ফেসবুকে অনেকেই আপত্তিজনক সেই ছবি শেয়ার করেছেন। এতেও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ছবি শেয়ারকারীদের মধ্যে স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাসহ নানা পেশার মানুষ ছিলেন। এতকিছু জানার পরও প্রশাসন কেন ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় নি?

গণমাধ্যমে এসেছে নাসিরনগরের হিন্দু বাড়িঘর এবং মন্দিরগুলোতে হামলার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। এটা কেন হলো? থানার ওসি এবং অন্য পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা কেন ওতোটা সক্রীয় ছিল না? সোমবারের শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশে জেলা প্রশাসক এবং জেলা এসপির উপস্থিতিতে নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নিজে শনিবার রাতের মাইকিংয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাহলে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তার বা তার পরিষদের ভূমিকা কি ছিল? তার কথা কি থানা-পুলিশ পাত্তা দেয় নি? না দিয়ে থাকলে কারণ কি? পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নাসিরনগরের ইউএনও কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন কিনা? চেয়ে থাকলে তাদের ভূমিকা কী ছিল?

ষষ্ঠত, স্থানীয় সংসদ সদস্য তথা মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী এ ঘটনার খবর কখন পেয়েছিলেন এবং তাঁর ভূমিকা কী ছিল? তিনি পরিস্থিতি সামলাতে কাদের কীভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন? নির্দেশ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ঠরা সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা?

সপ্তমত, হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার পেছনে কি শুধুই ধর্মীয় উন্মাদনা কাজ করেছে, নাকি উপজেলা বা নাসিরগরের বাইরের কোনো গোষ্ঠির পূর্ব-পরিকল্পনা জড়িত ছিল? এ ঘটনায় ভয়ার্ত হিন্দুরা এদেশ ছেড়ে ভারত চলে গেলে স্থানীয় কাদের লাভ? সম্পত্তি দখলের লোলুপ চোখ কারো কারো আছে কিনা?

তদন্ত কমিটিগুলোর উচিৎ হবে এ প্রশ্নগুলোর যথাযথ জবাব খোঁজা। এছাড়াও তারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতীতে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ রহস্য উদ্ঘাটন, বিশ্লেষণ এবং দোষীদের চিহ্নিত করে আইনী ব্যবস্থার সুপারিশ করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মঙ্গলবার নাসিরনগরে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুপাড়া ও মন্দিরগুলো পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি দল। এর আগে প্রশাসনের নানা স্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এসব স্থান পরিদর্শন করেছেন। সরকার হিন্দুদের নিরাপত্তা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সবকিছু করবেন বলে বিশ্বাস রাখি। সামাজিক সম্প্রিতি রক্ষায় সবাই এগিয়ে আসবেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই প্রত্যাশা করতেই পারি। নাসিরনগরের স্থানীয় মুসলমানদের একটা অংশ তাদের প্রতিবেশীদের রক্ষায় যেভাবে সাহস করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তা এখনো এই প্রত্যাশার খোরাক যুগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা আশা করছি পরিস্থিতির উন্নয়ন তথা মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্থানীয়রা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবেন। এই কাজে স্থানীয় মুসলিম সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় এ কাজ এখন জরুরী।

লেখক : সাংবাদিক ও গদ্যকার
সহ-সম্পাদক, দৈনিক সকালের খবর






Shares