Main Menu

ক্লিনিক ও টেস্ট

+100%-

%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93-%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%9fদুর্বার ২২ ডাক্তারি জীবনে দুটি বিষয় খুব কঠোরভাবে মেনে চলি-

এক. ডায়াগনস্টিক সেন্টার হতে ল্যাব টেস্ট বাবদ কোন কমিশন না নেওয়া।

দুই. কোম্পানির দেওয়া স্যাম্পল ওষুধ বিক্রি না করে গরিব রুগীদের দেওয়া।

প্রত্যেক সিদ্ধান্তের পেছনে ঘটনা আছে… সেসব ঘটনাই আমার চিন্তাভাবনাকে পাল্টে ফেলেছে…

আগে যখন বেসরকারি হাসপাতালে বেতনভুক্ত চিকিৎসক হিসেবে চাকুরি করতাম, তখন রুগীকে পরীক্ষার জন্য টেস্ট লিখে দিলে কোন কমিশন পেতাম না… তাই কমিশনের সাথে তেমন পরিচিতও ছিলাম না।

নতুন জায়গায় জয়েন করার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন দেখলাম, একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এক লোক এসে খাম দিল। দিয়ে বলল, স্যার এটা রাখেন।

খাম খুলে দেখি ভেতরে কিছু টাকার নোট… আর একটা সাদা কাগজে হিসেব করা… কোনদিন আমার কয়টা রুগী তাদের ওখানে টেস্ট করিয়েছে, তার হিসেব… এরপর মোট টাকার ৪০% আমাকে পাঠিয়েছে কমিশন হিসেবে!!

এই সিস্টেমের কথা শুনেছিলাম, কিন্তু বাস্তবে তখন সেটাই প্রথম দেখলাম। পরদিন দেখি, অন্য আরেকটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে খাম এল… দুদিন পর তৃতীয় আরেকটি থেকে… টাকা পেলে কার না ভাল লাগে!!

খাম পাওয়ার পরদিন যখন রুগী এল, প্রয়োজন বোধে তাকে একটা টেস্ট লিখে দিলাম… কিন্তু এসময় মনের ভেতর কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম… কেন জানি মনে ইচ্ছে হচ্ছিল, রুগী যেন বাহির থেকেই টেস্ট করায়!

রুগীর যা প্রয়োজন, সেই অনুযায়ীই আমি সবসময় টেস্ট দেই… কিন্তু খাম পাওয়ার পর প্রত্যাশার পরিবর্তন ঘটল… ইচ্ছে করে টেস্ট বেশি না দিলেও মনের ভেতর এক ধরণের প্রত্যাশা কাজ করা শুরু করল।

এভাবে সপ্তাহ তিনেক চলল… এক সন্ধায় এক রুগী এল…দেখেই বুঝা যাচ্ছে কৃষক মানুষ। তার রোগ নির্নয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা করতে দিলাম… সে পরীক্ষাগুলো করা সত্যি তার জন্য জরুরী ছিল। কিন্তু তার কাছে এতো টাকা নেই।

তখন তাকে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বললাম, এগুলো আপাতত খান… আর যদি পারেন, পরে একসময় টেস্ট করে আসেন।

পরদিন দেখি তিনি সব টেস্ট করে নিয়ে এসে হাজির। জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা কই পেলেন?

কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন, মহাজনের কাছে থেকে সুদের উপর টাকা ধার করে নিয়ে এসেছেন। সুদটাও অনেক বেশি… পুরো চক্রবৃদ্ধি হারে… অর্থাৎ সুদের উপরে সুদ জমা হয়ে তার উপর আবার সুদ দিতে হবে, যতদিন পর্যন্ত না পুরো টাকা শোধ করবেন।

সুদকে প্রচন্ড ঘৃণা করি… সুদ হল নিজের মায়ের সাথে যিনা করার চেয়েও জঘন্য। তাই সুদি ব্যাংকে কোন একাউন্টও খুলিনি, আবার সরকারি ফান্ডে যে জিপিএফ টাকা বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হয় সেটিও আবেদন দিয়ে বিনা সুদে করে নিয়েছি…

এরপর অনেক চিন্তা করা শুরু করলাম… শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, না, আর কখনো কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নিব না। বরং আমার যে কমিশন, সেটা রুগীকে ডিসকাউন্ট দিতে বলব।

এরপর থেকে রুগীদের সব সময় সকল টেস্ট সরকারিভাবে হাসপাতালেই করতে বলি। এতে খরচও কম হয়, কমিশনেরও কোন ব্যাপার থাকে না। আর যেসব টেস্ট সরকারিভাবে হয় না কিংবা বাহিরে কেউ করাতে চাইলে প্রেসক্রিপশনেই টেস্টের নিচে লিখে দেই “প্লিজ ডিসকাউন্ট”।

রুগীকে বলেও দেই ডায়াগনস্টিক সেন্টার ডিসকাউন্ট দিবে… এতে হয়তো আমি কমিশন পাচ্ছি না, কিন্তু আমার রুগীর, একজন মানুষের কিছু খরচ তো বাঁচাতে পারলাম….

বেশিরভাগ ডাক্তারই রোগের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকুই টেস্ট দেন… কিন্তু পাঁচ-দশ পার্সেন্ট ডাক্তার আছে যারা কমিশনের লোভে টেস্ট দেন… এবং তাদের কারণেই বদনাম বাকি ডাক্তার সমাজের।

তাছাড়া পল্লী চিকিৎসক, প্যারামেডিকসরা তো এখন এই কমিশনের লোভে রুগীর অনেক অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে তারপর আমাদের কাছে দিয়ে পাঠায়। কারণ, তারা টেস্ট করতে দিলেও টেস্ট রিপোর্ট পড়তে পারে না। তারা দিনে যদি দশ রুগী দেখে, আর প্রতি জনকে তিনশ টাকার টেস্ট দেয়, তাহলে এর ৪০% হিসেবে তাদের এমনি এমনি দৈনন্দিন আয় বারশ টাকা!!

এভাবে কমিশনের টাকা না নেওয়ার মানবতাবোধ বা নীতিগত ব্যপারও আছে… আমি তো একজন রুগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিনিময়েই আমার পারিশ্রমিক ফি নিচ্ছি, তাহলে টেস্ট থেকে কমিশন নেওয়া কোন সেন্সে আমার জন্য বৈধ হতে পারে?

মেডিকেল ইথিক্সেও এভাবে টেস্ট থেকে কমিশন নেওয়া আনইথিকাল কাজ…

একজন আলেমকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই ব্যপারে। তিনি বলেছেন, এটি অবৈধ উপার্জন হবে। যেখানে হারাম বলে সুদের সাথে যুক্ত হতে চাই না, সেখানে এই অবৈধ টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

আমার মতে, সরকারিভাবে আইন আরো কঠোর করে ডায়াগনস্টিক টেস্টের উপর কাউকে কমিশন দেওয়ার সিস্টেম একদম নির্মুল করা উচিত। এর পাশাপাশি, যে কমিশন রেফারারকে দেওয়া হয়, সেই পরিমাণ টাকা টেস্টের খরচ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কমাতে বাধ্য করা উচিত সকল ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে…

এর ফলে ল্যাব টেস্টের খরচও কমে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি নেমে আসবে, গরীব মানুষদের সুবিধাও হবে।

আমাদের দেশের মানুষরা চিকিৎসকের কাছে তখনই যায়, যখন একদম নিরুপায়, অসহায় হয়ে পরে। তাদের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া কখনোই উচিত নয়।

চেষ্টা করলেও আমরা সবাই হয়তো ভাল ডাক্তার হতে পারব না, কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই সবাই ভাল মানুষ হতে পারি.






Shares