Main Menu

সাঁতারে ক্ষিতীন্দ্রের বিশ্ব রেকর্ড

+100%-

টানা ৬১ ঘণ্টা সাঁতার কেটে ১৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছেন প্রবীণ সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতীন্দ্র। বুধবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টায় নেত্রকোনার মদন উপজেলার মগড়া নদীর দেওয়ান বাজার ঘাটে পৌঁছার পর তীরে ওঠেন তিনি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, মদন উপজেলার ইউএনও ওয়ালীউল হাসান, উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার খান এখলাছ ও মুক্তিযোদ্ধা সুকোমল বৈশ্যসহ স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাৎক্ষণিক অভ্যর্থনা জানানোর পর তাকে তীরে তুলে আনেন।

এ সময় নদীর দু’পাড়ে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ করতালির মাধ্যমে ৬৭ বছর বয়সী এ মুক্তিযোদ্ধা সাতারুকে অভিনন্দন জানান। তিনি নিজেও হাত নেড়ে উপস্থিত জনতার সঙ্গে ভাব বিনিময় করেন।

তীরে ওঠার পর সাতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যকে মদন উপজেলার হযরত সুমাইয়া (রাঃ) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মদন উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক চিকিৎসকের বরাত দিয়ে জানান, সাঁতারু ক্ষিতীন্দ্র বেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছেন। তাকে একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। তিনদিন পর (আগামী শনিবার) এ কৃতী সাঁতারুকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হবে।

জানা গেছে, গত সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টায় শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার ভোগাই নদীর সেতু এলাকা থেকে ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যের আনুষ্ঠানিক দূরপাল্লার সাঁতার প্রদর্শনী শুরু হয়। মদন উপজেলা নাগরিক কমিটি এবং নালিতাবাড়ি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। টানা ৬১ ঘণ্টার দূরপাল্লার সাঁতারে ভোগাই, নেতাই, কংস ও মগড়া নদীর ১শ ৮৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন তিনি। ৬১ ঘণ্টার প্রদর্শনী চলাকালে এক মিনিটের জন্য কোথায়ও থামেননি। ঘুমাননি একটুও। সাঁতার অব্যাহত রেখেই গ্রহণ করেছেন কফি, স্যুপ, জ্যুস প্রভৃতি তরল জাতীয় খাবার এবং ফলমূল। তিনটি ট্রলার ও একটি ছোট নৌকায় ৫০ সদস্যের একটি দল সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তাকে। রাতে জেনারেটরের সাহায্যে নদীপথে জালানো হয়েছে হ্যালোজেন বাতি। সাঁতারের তাল, ছন্দ ও গতি ঠিক রাখতে বাজানো হয়েছে পূর্ব নির্ধারিত বিভিন্ন ধরনের গান। অদম্য সাহস আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে ছন্দের তালে তালে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যান ৬৭ বছর বয়সী এ প্রবীণ সাঁতারু।

এদিকে ১শ ৮৫ কিলোমিটার নদী পথের দু’পাড়ে দাঁড়িয়ে লাখো লাখো মানুষ ক্ষিতীন্দ্রের সাঁতার প্রদর্শনী উপভোগ করেছেন। গভীর রাতেও নদীর পাড়ে ছুটে এসেছেন শিশু থেকে আবাল-বৃদ্ধবণিতা পর্যন্ত। বুধবার নেত্রকোনার মদনের দেওয়ান বাজার ঘাটে পৌঁছার আগে গোটা উপজেলা জুড়ে উৎসবের আমেজ দেখা দেয়। অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় স্থানীয় সব অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজ। মদন ছাড়াও দূর-দূরান্তের হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হয় নদীর দু’পাড়ে। কারও কাছে তিনি পরিচিত পান ‘জলমানব’ এর। আবার কেউ কেউ আখ্যায়িত করেন ‘জলকুমার’ হিসেবে।

ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য তীরে ওঠার পর তার ছেলে মিঠুন বৈশ্য তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘বাবার অদম্য সাহস এবং ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। এই বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা জীবনভর কঠোর সাধনা করে এসেছেন তিনি। কিন্তু তার বয়স এবং স্বাস্থ্যজনিত কারণে পরিবারের সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। এখন তীরে ওঠার পর কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছি।’

প্রদর্শনী শুরুর আগে ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য জানান, গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকে স্থান পেতে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি। তবে তার এ চ্যালেঞ্জ নতুন কিছু নয়। এর আগে গত বছরের (২০১৭) আগস্ট মাসে মাত্র ৪৩ ঘন্টায় ১শ ৪৬ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন তিনি। এবার নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙেন।

মদন উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক জানান, ‘ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যের সাঁতারের রেকর্ডটি অন্তর্ভূক্ত করতে গিনেজ ওয়ার্ল্ড বুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তাদের পরামর্শ মতো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রদর্শনীর ভিডিও ফুটেজ ধারণ করেছি আমরা। এটি গিনেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া হবে।’

মদন উপজেলার ইউএনও ওয়ালীউল হাসান ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যকে তার বিরল সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘তিনি আমাদের যুব সমাজের সামনে একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যাবসায় থাকলে যে কেউ তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন- এটি প্রমাণ করেছেন তিনি।’

মুক্তিযোদ্ধা সাঁতারু ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যের বাড়ি নেত্রকোনার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে। বর্তমানে তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এএনএস কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। ১৯৭০ সালে সিলেটের ধুপাদীঘি পুকুরে সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দীর বিরামহীন ৩০ ঘন্টার সাঁতার প্রদর্শনী দেখে সাঁতারে উদ্বুদ্ধ হন। পরে একই বছর মদনের জাহাঙ্গীরপুর উন্নয়ন কেন্দ্রের পুকুরে ১৫ ঘন্টার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে আলোচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে ৩৪ ঘন্টা, সুনামগঞ্জের সরকারী হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘন্টা, ১৯৭৩ সালে ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘন্টা, সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘন্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথহলের পুকুরে ৯৩ ঘন্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার কেটে জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করেন। জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করায় ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি জগন্নাথ হলের পুকুরে ১শ ৮ ঘন্টা ৫ মিনিটব্যাপী সাঁতার প্রদর্শন করে পুরাতন রেকের্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুরে পাড়ে একটি স্মারক (ফলক) নির্মাণ করে।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুল, মদন উপজেলা পরিষদের পুকুর এবং নেত্রকোনা পৌরসভার পুকুরে তাঁর একাধিক সাঁতার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ভারতেও দূরপাল্লার সাঁতারে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৯৮০ সালে মাত্র ১২ ঘন্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদীর জঙ্গিপুর ঘাট থেকে গোদাবরী ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেন ক্ষিতীন্দ্র।

সাঁতার প্রদর্শনী ও রেকর্ড সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে গণভবনে ডেকে নিয়ে রূপার নৌকা উপহার দেন। একই বছর ডাকসু তাঁকে বিশেষ সম্মাননা সূচক স্বর্ণপদক দেয়। এছাড়াও জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ দুই বার এবং শামছুন্নাহার হল কর্তৃপক্ষ একবার তাকে সংবর্ধনা ও স্বর্নপ্রদক প্রদান করে। গত বছর (২০১৭ সালে) সম্মাননা দেয়া হয় নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন, মদন উপজেলা প্রশাসন এবং উপজেলা নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে।