Main Menu

কাতারের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদের খতীব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাওলানা সাইফুল ইসলাম

+100%-

বিশ্বজয়ী হাফেজরা কেন বিশ্বজয়ী আলেম হয় না- কিছুদিন আগেও এ আলোচনা বেশ জোরেশোরে উঠেছিল। বিষয়টি আলোচনারও বটে। তবে এর ব্যতিক্রমও যে নেই এমন নয়। বাংলাদেশে সেই ব্যতিক্রম উদাহরণ তৈরি করেছেন হাফেজ কারী মাওলানা সাইফুল ইসলাম।

২০০৪ সালে এই দুবাইতেই হলি কুরআন এ্যাওয়ার্ড এ রানার্সআপ হয়েছিলেন হাফেজ সাইফুল ইসলাম। এরপর ২০১০ সালে জর্ডানে অনুষ্ঠিত তাফসিরুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করেন। এ প্রতিযোগিতায় প্রায় ৬৫’র মতো দেশ অংশ নিয়েছিল। অথচ হাফেজ সাইফুল ইসলাম তখন ফজিলত বিভাগের ছাত্র।

হাফেজ সাইফুল ইসলাম একজন মেধাবী হাফেজ ও আলেম। সে স্বাক্ষর তিনি জীবনের পরতে পরতে রেখে চলেছেন। দেশে দাওরা শেষ করে একই সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কাতার ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপ অর্জন করেছেন। চারবছর সেখানেই অনার্স সম্পন্ন করেন।

আর সম্প্রতি তিনি কাতার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুৎবা প্রদানের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন নিজের অসাধারণ আরবি বলা ও উপস্থাপনার দক্ষতায়।

মেধাবী সাইফুল ইসলামের দক্ষতা এখানেই শেষ নয়। বছরের বেশির ভাগ সময় কাতারে থেকেও তিনি ঢাকায় একটি নুরানী ও হিফজ মাদরাসা চালাচ্ছেন। নাম কা ওয়াস্তে নয়। মাদরাসার হিফজ বিভাগে দুইজন ছাত্র এবার বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় সিরিয়ালের দুই ও তিনে রয়েছে।

অবাক হওয়ার আরও বিষয় রয়েছে, মাদরাসায় তিনজন উস্তাদ থাকলেও কাতার থেকে তিনিই মূলত দেখাশোনা করেন প্রতিষ্ঠানটি এবং সেখান থেকেই তিনি স্কাইপেতে ক্লাস নেন।

মাদরাসায় বড় স্ক্রিনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে প্রিয় উস্তাদকে দেখেন তার ছাত্ররা। প্রতিদিন এভাবেই দরস নিয়ে অভ্যস্ত হয়েছে শিশু শিক্ষার্থীরা।

হাফেজ সাইফুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন রোকন রাইয়ান ও মুহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম।

ছোট থেকেই ছিল আরবির প্রতি ঝোঁক

হাফেজ সাইফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাদৈর গ্রামে। ধার্মিক পরিবারে জন্ম। বাবার নাম ডা. ওয়ালিউর রহমান। স্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে মাদরাসায় ভর্তি হন। হিফজ সম্পন্ন করেন খ্যাতিমান হাফেজে কুরআন মাওলানা আবদুল হকের কাছে। ২০১১ সালে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকাম মাদরাসায় থেকে।

হাফেজ সাইফুল ইসলাম কাতারের শায়েখদের মন জয় করেছেন খুৎবা দিয়ে। চমৎকার উপস্থাপনা ও সুগঠিত বাক্য চয়নে তৈরি করেন খুৎবা। এই যোগ্যতা তিনি কিভাবে অর্জন করলেন?

আসলে ছোট থেকেই তার ছিল আরবি বক্তৃতার প্রতি ঝোঁক। আরবরা কিভাবে কথা বলেন, কোন স্টাইলে কুরআন পড়েন এগুলো ফলো করতেন। তাই আরবিটা শিখে ফেলেন সহজেই। আর বক্তৃতার কলা কৌশলও আয়ত্ব করে ফেলেন।

তিনি বলেন, মাদরাসায় পড়ার সময় যেখানেই প্রতিযোগিতার কথা শুনতাম চলে যেতাম। আলহামদুলিল্লাহ এসব প্রতিযোগিতায় অধিকাংশই আমি বিজয়ী হতাম। তাই জীবনের অনেক পুরস্কার আমার ভাগ্যে জুটেছে।

পড়াশোনা

হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের চেয়াম্যান মাওলানা আব্দুল হকের কাছে হিফজ শেষ করার পর ২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকাম থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন। ২০১২ সালেই তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। এরপর ভর্তির জন্য নানা জায়গায় চেষ্টা করলেও চূড়ান্ত টার্গেট ছিল কাতার ইউনিভার্সিটি।

নিজের ইচ্ছা ও চেষ্টায় হতাশ হননি হাফেজ সাইফুল ইসলাম। সব জল্পনা কল্পনা উড়িয়ে তিনি স্কলারশিপসহ কাতার ইউনিভার্সিটিতে চাঞ্চ পেয়ে যান। চলতি বছর সেখান থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স সম্পন্ন করেন।

কাতারে যখন থেকে

কাতার ইউনিভার্সিটিতে ২০১২ সাল থেকে পড়াশোনা শুরু করলেও মূলত দেশটির মেহমান হওয়ার সুযোগ ২০০৪ সালে দুবাই হলি কুরআন অ্যাওয়ার্ড জয়ের পর থেকেই। প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হওয়ার পর দেশটির রাজ পরিবারের সদস্য আবদুল আজিজ বিন খালেদ আবদুল্লাহ আল সানি তাকে মেহমান করে নিয়ে যান। দেশে চলে এলেও মাঝে মধ্যেই হাফেজ সাইফুল ইসলামকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যেতেন তাদের পরিবারে। তার মুগ্ধ করা তেলাওয়াত শুনে মন জুড়াতেন।

তার যত অর্জন

হাফেজ কারী সাইফুল ইসলাম দেশের বাইরে অনেকগুলো পুরস্কার জিতেছেন। এসবের মধ্যে ২০০৪ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান, ২০১০ সালে জর্ডানে আন্তর্জাতিক তাফসীরুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান, ২০০৪ সালে সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ৪র্থ স্থান, ২০০৯ সালে ইরান আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ৪র্থ স্থান, ২০১৫ সালে আবারও জর্ডানে আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অর্জন করেন।

কাতার সেনাবাহিনীর মসজিদে খতীবের দায়িত্ব

কাতার ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় কাতারের অভিজাত এলাকা দাফনার সংলগ্ন রমিলার সেনাবাহিনীর অফিসারদের ২০৭ নং মসজিদে খতীব চেয়ে বিজ্ঞাপন দেখার পর সেখানে ইন্টারভিউ দেয়ার ইচ্ছে হয় হাফেজ সাইফুল ইসলামের। তবে বিষয়টা একেবারেই সহজ ছিল না। বাঙালি হওয়ায় অনেকে বিষয়টা নিয়ে হেয় করেছে। কিন্তু তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এখানে তিনি ইন্টারভিউ দিবেনই।

ইচ্ছেকে বাস্তবায়ন করতে সময়কে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। মেহনত করেছেন রাতদিন। খুৎবা যেন ভালো হয় সে প্রচেষ্টায় কমতি ছিল না তার। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। খতীবের তালিকায় এসেছে তার নাম। মসজিদটিতে তিনি এক বছর ধরে খতীবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

অনেক পুরস্কার আর সম্মাননা অর্জন করেছেন মাওলানা সাইফুল ইসলাম, এখানে তার কয়েকটি

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুৎবা

মূলত সেনাবাহিনী মসজিদের খুৎবাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গত রমজানে হঠাৎ করেই তার মোবাইলে কল আসে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ মসজিদে খুৎবা দিতে হবে। সেখানে কাতারের প্রেসিডেন্ট ও রাজপরিবারের সদস্যরাও নামাজ আদায় করবেন।

হাফেজ সাইফুল ইসলাম বলেন, ওই ফোন পাওয়ার পর আমি বেশ চিন্তিতই ছিলাম। দিলে ভয়ও ছিল বেশ। এখানকার জন্য আমি যোগ্য কিনা বা পারব কিনা এসব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। প্রথমে নাও করে দিয়েছিলাম কিন্তু তাদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারিনি।

তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ওই মসজিদ আমি চিনতাম না। সেটা বলার পর জুমার দিন দুই ঘণ্টা আগে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে নেয়ার জন্য। এভাবেই প্রতি জুমার আগে আমার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।

মারকাজুত তানযীল আল ইসলামিয়া ইন্টাঃ মাদরাসা

হাফেজ সাইফুল ইসলাম জানান, আমার ভবিষ্যত স্বপ্ন এখন এই মারকাজুত তানযীল। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্বজয়ী হাজেফের পাশাপাশি বিশ্বজয়ী আলেম তৈরি হবে। দীনের খেদমতে ছড়িয়ে পড়বেন বিশ্বব্যাপী।

২০১৬ সালে যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ চৌরাস্তার পাশে মাদরাসাটি চালু করেন তিনি। আবাসিক ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে এখানে অর্ধশত শিক্ষার্থী পাঠ নিচ্ছে। আপাতত নুরানী, নাজেরা ও হিফজ বিভাগ চালু থাকলেও পর্যায়ক্রমে মাদরাসাকে সম্প্রসারণ করবেন বলে জানান তিনি।

নিজস্ব জায়গায় স্থায়ী ও আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসও গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এর জন্য বসুন্ধরা রিভারভিউয়ে জায়গাও কেনা হয়েছে। খুব শিগগির সেখানে কাজ শুরু হবে বলেও জানান।

হাফেজ কারী সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশের জন্য একবুক গর্বের। তিনি বিশ্বের বুকে অসংখ্যবারই বাংলাদেশের নাম তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাশিক্ষা ও তার সফলতার জয়গান দেখিয়েছেন আরবের শায়েখদের। তার ভবিষ্যতও হবে এরকম স্বপ্ন ও সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোটি মানুষ এমনটাই আশা করেন।

 






Shares