Main Menu

কেন্দ্রীয় আ.লীগ নেতাদের পরিদর্শন, তদন্তে কমিটি গঠন, সম্প্রীতি সমাবেশ সত্বেও

নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের আতঙ্ক কাটেনি

+100%-

nm1এস. এম.  বদিউল আশরাফ( মুরাদ মৃধা):: নাসিরনগর থেকে : অনেক কষ্টে বছর দুয়েক আগে টিনের ঘর তুলেছিলেন নিরঞ্জন গোপ। রোববারের হামলায় সেই ঘরটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঘর ভাঙার সময় কথা বলায় তার স্ত্রী সজলা রাণী গোপকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে হামলকারিরা।
মাছ ধরার একটি জালই একমাত্র সম্বল ছিল কাশিপাড়ার মানিক দাসের। হিংস্রতার আগুনে সেই স্বপ্ন পুড়ে গেছে তার। পুড়া জালের সামনে দাঁড়িয়ে বাকরুদ্ধ মানিক দাস।
ছেলের বিয়ের সময় পাওয়া দুই ভরি স্বর্ণালংকার ও জমানো পাঁচ হাজার টাকা লুট হয়ে যাওয়ায় বিলাপ করছিলেন একই পাড়ার পূর্ণিমা দাস। তবে নিজে মারধরের শিকার হলেও লুকিয়ে থাকায় ছেলের বউ কিংবা ছোট্ট নাতির উপর আঘাত আসেনি-এই ভেবেই শান্তনা খোঁজছিলেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরের বাসিন্দা নিরঞ্জন গোপ, মানিক দাস ও পূর্ণিমা দাসদের মতো বহু পরিবার গত রোববার (৩০ অক্টোবর) সাম্প্রদায়িক তান্ডবের শিকার হয়েছেন। সেদিন দুপুর ১২টা থেকে দেড়টা পর‌্যন্ত চলা তান্ডবের দুদিন পর সেখানকার পরিস্থিতি এখন শান্ত। তবে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাটেনি।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার প্রতিবাদের নামে উপজেলা সদরের অন্তত দেড় শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও সার্বজনীন পাঁচটিসহ ১৫ টি মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট করেছে ‘সুযোগ সন্ধ্যানী’ একটি মহল।
এর আগে গত শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের রসরাজ দাস (২৭) নামে এক যুবক পবিত্র কাবা ঘরের ছবি এডিট করে এর উপর শিবমূর্তি বসিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করায় স্থানীয়রা তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে পরদনি শনিবার দিনভর নাসিরনগর সদর উত্তাল হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় রোববার সকালে উপজেলা সদরের কলেজ মোড়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতারা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়। অপরদিকে একই সময়ে খেলার মাঠে কওমী মাদ্রাসার লোকজন সমাবেশ করে। সেই সমাবেশ চলাকালেই হিন্দুপাড়াগুলোতে তিন-চারশ লোক লাঠিসোটা নিয়ে ঢুকে বর্বরোচিত হামলা চালায়।

ehs111
ঘন্টা দেড়েক আটটি হিন্দুপাড়ায় তান্ডব চালিয়ে অন্তত ১৫টি মন্দির ও দেড়শ’র মতো বাড়িঘর ভাংচুর-লুটপাট করা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই দিন থেকে উপজেলা সদরে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব মোতায়েন রয়েছে।
এ ঘটনার পর উপজেলা সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া পাড়া, মহাকাল পাড়া, কাশিপাড়া, নমশুদ্রপাড়া, মালিপাড়া, শীলপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, ভাংচুর-লুটপাট করা মন্দিরগুলোর প্রতিমা টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে পূজার সামগ্রী। দুদিন পরও লুটপাটের চিহ্ন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে । মন্দিরের বাইরেও মুর্তি ভেঙ্গে ফেলে রাখা হয়েছে।
একই রকম দৃশ্য দেখা গেছে বসতবাড়িতেও । দুপুরে খাওয়ার জন্য রান্না করা খাবার পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘরের আসবাবপত্রগুলো চুরমার। লুট করে নেওয়া হয়েছে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার।

মামলা দায়ের, আটক ৯
এদিকে রোববার তান্ডবের পর ক্ষতিগ্রস্থ দত্ত বাড়ির কাজল জ্যোতি দত্ত ও গৌর মন্দিরের পক্ষে নির্মল চৌধুরি বাদী হয়ে নাসিরনগর থানায় দুটি মামলা দায়ের করেছেন। এসব মামলায় এক হাজার করে অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ৯ জনকে আটক করেছে। তবে আটকদের নাম-পরিচয় জানায়নি পুলিশ।
ইউএনও-ওসির অপসারণ দাবি
রোববার রাতে এ ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদেরের অপসারণ দাবি করে বিবৃতি দেয় জেলা আওয়ামী লীগ।

ঘটনা তদন্তে কমিটি
ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা তৈরি করা শুরু হয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলায় অংশ নেয়া অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। হামলায় কারো কোনো ইন্দন ছিল কি-না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রসরাজ দাসের রিমান্ড আবেদন
%e0%a6%b0%e0%a6%b8%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c-%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%b8রসরাজ দাস নামের যুবক গ্রেপ্তারের কিছু সময় আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানায়, এর সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন। কিভাবে তা হলো তা তিনি বুঝতে পারছেনা। ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে তিনি ওই ছবিটি তার পেজ থেকে ডিলিট করে দেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তার রিমান্ড আবেদন করেছে।

কিছু হামলাকারি চিহ্নিত
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হামলাকারিদের বেশিরভাগই অপরিচিত। হামলাকারিদের বেশিরভাগই ছিল প্যান্ট, শার্ট পরিহিত যুবক। যে কারণে হামলাকারিদের সম্পর্কে আইন শৃংখলা বাহিনীকে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্থরা। তবে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন হামলাকারিদের চিহ্নিত করতে মাঠে নামে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মো. আব্দুল করিম জানান, হামলায় অংশ নেয়া বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সম্প্রীতি সমাবেশ
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার বিকেলে প্রশাসনের উদ্যোগে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করা হয়েছে। সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে বসবাসের জন্য সকলের প্রতি আহবান জানানো হয়।
যা বললেন প্রশাসন
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল কাদের জানান, এ ঘটনায় থানায় দুটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদেরকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে হামলাকারিদের অনেকেরই নাম জানা গেছে। তাদেরকে গ্রেপ্তারে পুলিশ জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জেলার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ’ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির তদন্তে দায়িত্ব পালনে কারো কোনো গাফিলতি পাওয়া গেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া ও হামলাকারিদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলেও জানান তিনি ।
জেলা প্রশাসক ড. রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ’এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। এখন আমরা প্রশাসনিক দিক নিয়ে এগুচ্ছি। তদন্ত রিপোর্ট পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ehsকেন্দ্রীয় আ.লীগ নেতাদের পরিদর্শন
মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘর পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বলেন, বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতা নষ্ট করতে দেয়া হবে না। যতদিন শেখ হাসিনা থাকবে ততদিন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ ঘটনায়আজ গণভবনে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি ক্ষতিগ্রস্থদের মন্দির পুনঃনিমার্ণসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় কার্য নিবার্হী সংসদের সদস্য গোলাম রাব্বানী চিনু ও মারুফা আক্তার পপিসহ চার সদস্যের প্রতিনিধিদল সকাল ১১ টার দিকে গৌর মন্দির, দত্তবাড়ি মন্দির, কালিবাড়ি মন্দির, জগন্নাথ মন্দিরসহ বিভিন্ন বাড়িঘর পরিদর্শন করেন ও আহত এবং ক্ষতিগ্রস্থ হিন্দু পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলেন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুদান

dc11116মঙ্গলবার বিকালে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার কাযালয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ১১টি মন্দিরে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নগদ পাচঁ হাজার টাকা করে ও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৩টি মন্দিরে দশ হাজার টাকার অনুদান তুলে দেন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোঃ রেজওয়ানুর রহমান।






Shares