Main Menu

সরাইলে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্মভিটার স্মৃতি হারাতে বসেছে

+100%-

মোহাম্মদ মাসুদ, সরাইল ॥ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল উপজেলা’র কালিকচ্ছ ইউনিয়নের বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের জন্ম ভিটে। তার পৈত্রিক ভিটেটি আজ বিলীন হতে চলছে। বাড়ির সামনের অংশ কে পিছনে ফেলে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমানে ক্রয় সূত্রে দখলে রাখা কালিকচ্ছ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আহমেদুর রহমান এর পরিবার। তাদের দাবি তারা এই বাড়িটি ক্রয় করে এখানে বসবাস করছেন। তবে অনেক বছরের পুরনো এই স্থাপনাটি অনেক বার ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। স্থানীয় সুশীল সমাজের লোকজনের কারণে তা ভাঙা সম্ভব হয় নি। বর্তমানে বাড়িটিকে পেছনে রেখে গত দুদিন আগে বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।

প্রতিদিন দেশ বিদেশ থেকে অনেক কবি সাহিত্যিক ও গবেষক এই বাড়িটি দেখতে আসেন। বাড়িটি নিয়ে দেশ বিদেশের অনেক গনমাধ্যমেও সংবাদ ছাপা হয়েছে। এছাড়াও ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উল্লাসকর দত্তের অনেক ভূমিকা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এনিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

বর্তমানে উল্লাসকর দত্তের বাড়িটি সংরক্ষনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ও সুশীল সমাজের লোকজন।

এখানে দেশ ও দেশের বাইরের মানুষ ছুটে আসেন বাড়িটি এক নজর দেখার জন্য। যদিও সরকারি ভাবে এটি সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্বাবধানে থাকলে হয়তোবা বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের ইতিহাস ঐতিহ্য মানুষের মনে থেকে যাবে। নয়তো হারিয়ে যাবে এই বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্ম ভিটের ইতিহাস ঐতিহ্য।

সরাইল উপজেলা’র কালিকচ্ছ ইউনিয়নের দত্ত পড়া এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন উল্লাস কর দত্ত। ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল বিপ্লবী এই নেতার। তার পিতার নাম ছিল দ্বিজ দাস। তিনি ওপার বাংলার কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃষি বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক রাসেল বাঙালিদের সম্পর্কে কটুক্তি করার দরুন উল্লাস কর তাকে আঘাত করেন। এরজন্য উল্লাস কর দত্তকে কলেজ থেকে বহিস্কৃত হতে হয়েছিল।

তখন থেকে উল্লাস কর দত্তের পরিবর্তন । ঐ সময় থেকে তার জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিপিন চন্দ্র পালের অনুপ্রেরণাতেই উল্লাসকর দত্ত প্রথম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময় থেকেই ধুতি পাঞ্জাবি পড়া শুরু করেন তিনি। পরে যুগান্তর দলে যোগ দেন উল্লাস কর দত্ত। তিনি বিস্ফোরক নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার দেয়া ফরমূলায় তৈরী বোমা পরীক্ষা করার জন্যে একদল বিপ্লবী বেছে নেন দেওঘরের নিকট নির্জন দীঘারিয়া নামের পাহাড়।

১৯০৮ সালের ১ মে সেই পরীক্ষার দিন বোমা ছোড়ার সময় আহত হয়ে মারা যান বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। তখন উল্লাসকর ও মারাত্মক জখম হন।

সে সময় গোপনে কলকাতায় তার চিকিৎসা করেন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক। তখন উল্লাসকরের তৈরি বোমায় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণে ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই হামলা এক সময় বানচাল হয়ে যায়। সেসময় পুলিশ উল্লাসকর দত্ত সহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে।

উল্লাসকর দত্ত ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ মে মুরারিপুকুর বাগানে ধরা পড়েন । ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলা নামের এই বিখ্যাত মামলায় উল্লাসকর ও বারীন ঘোষকে ফাঁসীর আদেশ দেয়া হয়।

তবে পরবর্তীকালে এই সাজা পরিবর্তন করে তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা দেয়া হয়। আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে উল্লাসকর দত্তকে শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

১৯২০ সালে উল্লাস কর দত্তকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি কলকাতা শহরে ফিরে আসেন। উল্লাসকর দত্ত কে পরে ১৯৩১ সালে আবারও গ্রেফতার করা হয়, ও ১৮ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পর তিনি কালিকচ্ছ গ্রামের দত্ত পাড়ার এ বাড়িতে ফিরে আসেন।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে বিশিষ্ট নেতা বিপিনচন্দ্র পালের বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেন । ওই বাড়িতে ১০ বছর কাটানোর পর তিনি ১৯৫৭ সালে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। উল্লাসকর দত্ত পাড়া তার শেষ জীবন শিলচরে কাটান। সেখানেই ১৯৬৫ সালের ১৭ই মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

উল্লাস কর দত্তের বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য বহুবার সুশীল সমাজের লোকজন ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ দাবি জানালেও এর কোন সুফল আসেনি। বর্তমানে উল্লাস কর দত্তের বাড়িটি তার ঐতিহ্য ও ইতিহাস হারাতে বসেছে।

সরাইল ইতিহাস সংরক্ষণ পরিষদের সহ সাধারণ সম্পাদক,লেখক, কবি প্রকাশক ও ত্রিতাল সংগীত নিকেতনের অধ্যক্ষ সঞ্জীব কুমার দেব নাথ বলেন, বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য আমরা দাবি জানাই। এছাড়া বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

সরাইল উপজেলা চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর বলেন, বাড়ির মালিক কে ন্যায্য মূল্য দিয়ে বাড়িটিকে সংরক্ষণ করা হউক।

সাবেক দুইবারের সাংসদ এডঃ জিয়াউল হক মৃধা বলেন, আমি বহুবার জাতীয় সংসদে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন জানিয়েছি ও বর্তমান মালিক কে সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে বাড়িটিকে একটি মিউজিয়াম করার জন্য আবেদন জানিয়ে ছিলাম। বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কাছে আমার আবেদন বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য তিনি সুদৃষ্টি দিবেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিন বলেন, আমি বিষয় টা জানতাম না আমি এই মুহূর্তে আপনাদের কাছ থেকে জানলাম। আমি বিস্তারিত জেনে পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।






Shares