Main Menu

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল :: ছয় মাসেও চালু হয়নি ডিজিটাল এক্স-রে

+100%-

ডিজিটাল এক্স-রের চাহিদা এখন সর্বত্র। চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে বেশির ভাগ সময়ই ডিজিটাল এক্স-রে করার কথা লিখে দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে প্রায় ছয় মাস আগে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন আনা হলেও সেটি এখনো চালু করা হয়নি।

রবিবার সকালে হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কক্ষে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ওই বিভাগের অন্য দুটি কক্ষে পুরনো এক্স-রে মেশিন দিয়ে এক্স-রে করা হচ্ছে। এ বিভাগের জনবলসংকটের কারণে কর্মীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো সফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ডিজিটাল এক্স-রে চালু করার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লেখা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই যন্ত্রটি চালু করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, বাইরে থেকে ডিজিটাল এক্স-রে করালে চার-পাঁচ শ টাকা লাগে। অন্যদিকে সরকারিভাবে সম্ভবত দেড়-দুই শ টাকা নেওয়া হতে পারে। লোকবল সংকটের বিষয়েও চিঠি লেখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতাল ঘুরে সেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংকট চোখে পড়ে। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসক কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটের বিষয়টিও উঠে এসেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কথায়।

জেলার আখাউড়া উপজেলার তন্তর গ্রামের বুলু মিয়া বুকের ব্যথা নিয়ে গত শনিবার রাত ১১টার দিকে হাসপাতালে ভর্তি হন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন, যেগুলো বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হয়েছে। অথচ হাসপাতালেই এ সুবিধা রয়েছে।

বুলু মিয়ার ভাই আকরাম হোসেন জানান, গত শনিবার রাতে বাইরে থেকে যে পরীক্ষা তিনি ৪০০ টাকায় করিয়েছেন, পরদিন সকালে হাসপাতালে ওই পরীক্ষা ৮০ টাকায় করান।

পায়ের ব্যথা নিয়ে গত ৩১ জুলাই থেকে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরা এলাকার ফরিদ মিয়া। গত ২০ দিনেও রাতের বেলা কোনো চিকিৎসক এসে দেখেননি বলে জানান তিনি। ১৫ আগস্ট থেকে ভর্তি থাকা কসবা উপজেলার সোনারগাঁও গ্রামের মো. আব্দুস সাত্তার, সদর উপজেলার সিন্দুউড়া গ্রামের ফারুক মিয়া, বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর গ্রামের চান মিয়াও জানালেন একই কথা।

রোগী ও হাসপাতালের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি বিভাগ বাদে সাতটি ওয়ার্ডের বেশির ভাগেই রাতের বেলা কোনো চিকিৎসক আসেন না। তবে শুধু কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এম এ এহসান রাতের বেলায়ও ওয়ার্ডে রোগীদের দেখেন (রাউন্ড)। তিনি ছুটিতে কিংবা অন্য কোনো কারণে না থাকলে আরেকজন চিকিৎসক রোগী দেখেন। অথচ দিনের মতোই রাতের বেলা চিকিৎসকদের ওয়ার্ডে রোগী দেখার নিয়ম রয়েছে।

অবশ্য চিকিৎসকদের মতে, খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে সব বিভাগে রাতে রোগী দেখার প্রয়োজন নেই। দিনভর রোগী দেখে রাতে আবার হাসপাতালে আসাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে প্রয়োজন পড়লে ঠিকই তাঁরা ছুটে আসেন।

রবিবার দুপুর ২টার দিকে তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে বসে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এ মত ব্যক্ত করেন।

অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স ফেরদৌসি আক্তার জানান, রাতে ওয়ার্ড বয়, সুইপার থাকেন না বলে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। আরেকটি ওয়ার্ডের নার্স জানান, রাতে মূলত তাঁরাই রোগীদের দেখভাল করেন। বিশেষ প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসককে ডাকেন।

রাতে হাসপাতালটিতে এক প্রকার অন্ধকারময় পরিবেশ বিরাজ করে। শনিবার রাতে হাসপাতালের মূল ভবনে প্রবেশ করার মুখে চারটি বৈদ্যুতিক বাতির একটি জ্বলতে দেখা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডেও আলোর স্বল্পতা লক্ষ করা গেছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে হাসপাতালটিতে নেমে আসে ভুতুড়ে পরিবেশ। কেননা খুব বেশি জরুরি প্রয়োজন না হলে জেনারেটর চালানো হয় না বলে স্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতায় এ কৃচ্ছ্রসাধন করা হয় বলে জানা গেছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, বৈদ্যুতিক বাতি ও ফ্যানের কিছু সমস্যা রয়েছে। এগুলো দূর করা হবে। প্রতি ঘণ্টায় ১৫ লিটার তেলের প্রয়োজন হয় বলে জেনারেটর চালু করা হয় না। কেননা তেলের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। রোগীদের প্রয়োজনে চিকিৎসকরা রাতেও হাসপাতালে আসেন বলে দাবি করেন তিনি।

হাসপাতালের আন্ত বিভাগে মোট সাতটি ওয়ার্ড রয়েছে, যেখানে ভর্তীকৃত রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব ওয়ার্ডের সব কটি ঘুরে দেখা গেছে নাজুক অবস্থা। বিশেষ করে রোগীদের জন্য বরাদ্দ টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী। প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই এসব ওয়ার্ডে নেই। তবে হাসপাতালের চতুর্থ তলার ভিআইপি কেবিনগুলোর অবস্থা বেশ পরিচ্ছন্ন লক্ষ করা গেছে।

পেয়িং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষের ১৩টি শয্যার মধ্যে ১১টিতে এবং নারীদের ১২টি শয্যার মধ্যে ছয়টিতে রোগী আছে।

অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ড বয় মো. শহীদ ও মো. জাকির রোগীদের ড্রেসিং করছেন। সিনিয়র স্টাফ নার্স সৈয়দা আকলিমা বলেন, ‘এখানে কর্তব্যরত ব্রাদার নাইট ডিউটি করেন। যে কারণে তাঁদের সহযোগিতায় ওয়ার্ড বয়রা ড্রেসিং করেন। বিশেষ প্রয়োজন হলে তাঁরা চিকিৎসককে খবর দেন। ’

কার্ডিয়াক বিভাগে ‘কার্ডিয়াক বেড’, যেগুলো মুভ করা যায় তা প্রয়োজন বলে জানান সেখানে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স মধুমিতা পাল।

মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে ভিন্ন চিত্র লক্ষ করা যায়। এখানে ৩৬টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে ৬৪ জন রোগী। এ কারণে অনেক রোগীকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। ডায়রিয়া ওয়ার্ডেও ২০টি শয্যার বিপরীতে ৩০ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডেও শয্যার চেয়ে রোগী বেশি।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানিয়েছেন, হাসপাতালটি ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও ভবন বাড়েনি। যে কারণে রোগী সামাল দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। ওয়ার্ডের টয়লেটগুলো সংস্কারের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লেখা হয়েছে।

হাসপাতালের নিচতলার ১১৭ নম্বর কক্ষ থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হয়। রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে ঘোরার সময় দেখা যায়, ওই কক্ষে দুটি কাউন্টার থাকলেও একটিতে ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। যে কারণে সারিতে দাঁড়িয়ে ওষুধ নিতে গিয়ে বিশেষ করে নারীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

১০৯ নম্বর কক্ষ থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আসা সরাইল উপজেলার সাহিনা জানান, চিকিৎসক ছয়টি ওষুধ দিলেও তাঁকে শুধু একটি ওষুধের দুই পাতা এখান থেকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছে। হাতে নিয়ে দেখা গেল, ওষুধের গায়ে ভিটামিন-বি লেখা। আজহার উদ্দিন নামের আখাউড়া মনিয়ন্দের এক যুবক জানান, তিনিও শুধু দুই পাতা ভিটামিন-বি ট্যাবলেট পেয়েছেন। চিকিৎসক তাঁর বোন সীমার ব্যবস্থাপত্রে ছয়টি ওষুধ লিখেছেন। বাকিগুলো বাইরে থেকে কেনার জন্য তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আরো অনেককেই প্যারাসিটামল, টেট্রাসাইক্লিনসহ তিন-চার ধরনের ওষুধ নিয়ে কাউন্টারের সামনের সারি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। অথচ সামনে টানানো একটি তালিকায় ৩০টি ওষুধের নাম লেখা আছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, হাসপাতালে ওষুধের কোনো কমতি নেই। সরকারিভাবে যেসব ওষুধ বরাদ্দ দেওয়া হয় সেগুলোই শুধু এখান থেকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। এর বাইরে কোনো ওষুধ লেখা হলে রোগীকে সেগুলো কিনতে হবে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালে ৪২ জন কনসালট্যান্ট ও মেডিক্যাল অফিসার থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন ৩০ জন। অস্থায়ীভাবে ১৫ জনের মধ্যে রয়েছে ১৪ জন। শিশুসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে চিকিৎসক সংকট থাকায় সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ৪১ জন কর্মচারীর বদলে রয়েছে ৩১ জন। ৬৬ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে রয়েছে ৬২ জন। এর বাইরে ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগকৃত কর্মচারী এখানে মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন।

রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের টেকনোলজিস্ট জহিরুল ইসলাম জানান, এখানে তিনজন লোকের প্রয়োজন হলেও একাই তিনি চালাচ্ছেন। এ ছাড়া একজন টেকনোলজিস্টের ৩০টির বেশি এক্স-রে করার নিয়ম না থাকলেও তিনি বাধ্য হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০টি করছেন। এতে তিনি শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, কখনো কখনো এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১২০০ থেকে ১৫০০ রোগী দেখতে হয় চিকিৎসকদের। আর এ চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে তাঁদের জন্য। এ অবস্থায় চিকিৎসকসহ অন্যান্য বিভাগে লোক নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি লেখা হয়েছে।






Shares