Main Menu

২২ নভেম্বর ২০১৮ইং সাবেক সাংসদ এডঃ লুৎফুল হাই সাচ্চুর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী

+100%-

ব্রাহ্মণবাড়িয়া২৪.কম ডেস্ক:: ২২ নভেম্বর ২০১৮ইং রোজ বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনমানুষের নেতা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চুর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের এই দিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকা গুলশানের বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। লুৎফুল হাই সাচ্চু ১৯৭০-এর নির্বাচনে মাত্র ৩০ বছর বয়সে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী লুৎফুল হাই সাচ্চু
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের কাছে তিনি ক্লীন ইমেজের নেতা হিসেবে সকলের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি মহলের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধারপাত্র। মহান এ রাজনীতিক ৪৮বছর ধরে সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। একাত্তরের রনাঙ্গনে অন্যতম পুরোধা লুৎফুল হাই সাচ্চুর নিজের কোন বসত ভিটি পর্যন্ত নেই।

স্বাধীনতা স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংগে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি প্রথম ২৬ মার্চ কারফিউ ভঙ্গের নির্দেশ প্রচার করেন। আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে এ মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সাধারণ মানুষ অবশ্য তাঁকে নির্লোভ, ত্যাগী, আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবেই চেনেন। বয়সের ভার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে কাবু করতে পারেনি।

৭৩ এর ঘরে বয়স ছুঁই ছুঁই করলেও তরুনদের মতই ছিল তার চলাফেরা। সদালাপী, এই মুক্তিযোদ্ধা রবিবারও ব্রাক্ষনবাড়িয়ার নিজ বাসভবনে একাধিক বৈঠক করেন। রাত ১২টা পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মীদের সময় দেন। তাঁর চলাফেরা, জীবন-যাপন ও স্বাভাবিক কাজে ছন্দপতন ঘটেনি শেষ বিদায় পর্যন্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ এক ডাকে সৎ মানুষ হিসেবে চেনেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বীর সেনানীকে নিয়ে এখানকার মানুষ গর্ব বোধ করেন। আপাদমস্তক সৎ রাজনীতিবিদ লুৎফুল হাই সাচ্চু মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের গেরিলা উপদেষ্টা ছিলেন। ২২ বছর বয়সে তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। টানা ৩২ বছর ব্রাহ্মনবাড়িয়া আওয়ামীলীগের জেলা সম্পাদকের পদে অপ্রতিদন্দ্বী ছিলেন।

একাত্তরের রনাঙ্গনের এ বীরের জন্ম ১৯৪০ সালে। পিতা প্রয়াত আব্দুল হাই। তাঁর পিতা পূর্ব বাংলার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে ১৯৩০ সালে চাকুরীতে যোগ দেন। পর্যায়ক্রমে আবদুল হাই বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম, এ পাশ করেন। ১৯৬৪ সালে ডেপুটি সেক্রেটারী হিসেবে অবসর নেন।

৫ভাই, ৫বোনের মধ্যে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। প্রায় সময়ই সাংবাদিকের সাথে আলাপচারিতায় লুৎফুল হাই সাচ্চু তার জীবন দর্শন সম্বন্ধে নানা বর্ণনা দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পত্র-পত্রিকায় নানামুখী সংবাদ দেখে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান লুৎফুল হাই সাচ্চু তখনকার ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৭ সালে পিতার চাকুরীর সুবাদে মাগুড়ায় যান। সেখানে থাকাবস্থায় মাগুড়া কলেজের ছাত্রলীগ থেকে জি, এস পদে নির্বাচিত হন। ২২ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্যপদ লাভ করেন। এর আগে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব বিরোধী মার্শাল ’ল ভাঙ্গতে গিয়ে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৬০-৬২সালে আইয়ুব বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনের তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিনি। ঐ সময় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বর্তমান সরকারী অনার্স কলেজ পুরোধা হিসেবে ছাত্র আন্দোলন চাঙ্গা করেন।

আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তাঁর বিরুদ্ধে ৩টি মামলা হয়। হুলিয়া জারির পরেও দমে যাননি অকুতোভয় লুৎফুল হাই। ঐ সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ইলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ৬ দফা আন্দোলনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। সে সময় ঢাকায় এস, এস, এফ’র নির্যাতনে দীর্ঘ দেড় মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বাধিক আলোচিত কোকিল সুতাকলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ মিলের সভাপতির পদে ছিলেন। ঐ সময় তার সহায়তায় তৎকালীন সরকার ৮২লক্ষ টাকা মুনাফা পায়। ১৯৬৮ সালে ঢাকা কোর্টে আইন পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন। ৭৬ সালে সুপ্রীম কোর্টের সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭০সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপে ২৬ মার্চ সকালে পাক বাহিনীর আরোপিত র্কাফু অমান্য করে জনগনকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু আদেশে আদিষ্ট হয়ে তিনিই প্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাটারী অপারেটেড হ্যান্ড মাইক যোগে কারফিউ অমান্য করার ঘোষনা দেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা লগ্নে ভারতে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের বিশেষ প্রশিক্ষন লাভ করেন। এর পর মুক্তিযুদ্ধের ২ ও ৩নং সেক্টরের গেরিলা উপদেষ্টা হন। সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় মুক্তিযুদ্ধের যানবাহনের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। যুদ্ধের ৯টি মাস এখানে সেখানে চষে বেড়ান। পাক ঘাতকরা তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। যুদ্ধের সময় তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌলভীপাড়াস্থা পৈত্রিক বাসভবনে পাক বাহিনী তাণ্ডব চালায়। বিধ্বস্ত করে তার পিতার ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুরের বাসাও। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে যুদ্ধকালীন সময়ে ছয়বার নিজের শরীর থেকে রক্ত দেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ পূর্ণগঠনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। মূলতঃ আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর কাছে চলে আসেন। ৭২সালে মহকুমা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩২ বছর ধরে এ পদে আসীন থাকেন। ২০০৩ সাল থেকে অমৃত্যু তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

আপাদমস্তক সৎ এ রাজনীতিবিদ মৃত্যুর আগে গনমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ২২ বছর বয়সে ছাত্র রাজনীতির সংগে জড়িত হই। এখন ৭৩ বছর। ৪৮ বছর রাজনীতি করছি। নিজের এক খন্ড জমি নেই। পৈত্রিক বাড়িতে এখনও বাস করতে হচ্ছে। সহায়-স্ম্পত্তির প্রতি মোহ নেই। ৪৮ বছর ধরে অবিরাম মানুষের সেবা করছি। সেবা যেখানে মুখ্য সেখানে চাহিদা নেই। দেশের চলমান রাজনীতির সংগে নিজেকে মানানসই করতে পারেনি। দুর্নীতি কি জিনিস তা ভাবতে পারি না। এ জন্য হয়তো আমার দৈন্যতা। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন জেনারেল জিয়া ৭০’র শেষ দিকে প্রস্তাব দিয়েছিল তার দলে ভেড়ার। টোপ দেয়া হয়েছিল মন্ত্রিত্বের। শুধু তাই নয়, লৌহ মানব এরশাদও এমন অফার দিয়েছিলেন। টোপ গিলিনি। দেশের মানুষের জন্য ভালবাসা আদর্শ, ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধেও কমিটমেন্ট এসব কিছুই আমাকে অন্য কোথাও যেতে বিপত্তি সৃষ্টি করেছে। যতদিন জীবিত থাকব, বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসব, আদর্শও নীতিচ্যুত হব না। স্বাধীন বাংলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়া ছিল তার জীবনের শেষ ইচ্ছা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি তার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী বিএনপির হারুন আল রশিদকে ৭৪হাজার ভোটে পরাজিত করে জয়লাভ করেন।






Shares